সন্ধ্যায় মেসেজ এলেই আঁতকে ওঠেন ইডিসিএলের কর্মীরা
প্রকাশ: ২৫ মে ২০২৫, ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন | জনদুর্ভোগ

ছাঁটাই আতঙ্কে সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) কর্মীরা। সন্ধ্যা হলেই সংস্থাটির কিছু কর্মীর মোবাইলে মেসেজ আসে অস্বাভাবিক লেনদেনের। না, এটি খুশির খবর নয়। চাকরিচ্যুত করার মেসেজ। পাওনাদি ব্যাংকে দিয়ে পরে ডাকে টারমিনেশন লেটার পাঠিয়ে দেয় স্বায়ত্তশাসিত কোম্পানিটি। এভাবে গত মাসে প্রায় ৪শ কর্মী ছাঁটাই করেছে ইডিসিএল। প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি জনবল থাকায় এমন ছাঁটাই কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীলরা। ফলে প্রায় তিন হাজারের বেশি কর্মীই এখন আতঙ্কে।
১৯৮৩ সালে এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) প্রতিষ্ঠা করে সরকার। ঢাকায় প্রধান কারখানা ছাড়াও খুলনা, বগুড়া, গোপালগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে এসেনসিয়াল ড্রাগসের প্ল্যান্ট রয়েছে। উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী কোম্পানির জনবল দরকার সর্বোচ্চ আড়াই হাজার। কিন্তু সেখানে কাজ করেন পাঁচ হাজার ৬শ মানুষ। তিন হাজারের বেশি বাড়তি লোক কাজ করে প্রতিষ্ঠানটিতে।
এই অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের মূলহোতা সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এহসানুল কবির। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক ২০১৪ সালে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) এমডি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক। তার হাত ধরেই আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তিন হাজারের বেশি বাড়তি লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। সাবেক এমডি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা বা অনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন না তুলে অতিরিক্ত জনবল দেখিয়ে গত এপ্রিল মাসের ১০ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত বগুড়া, খুলনা, গোপালগঞ্জ ও ঢাকা অফিস থেকে ৪শ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বগুড়া প্ল্যান্টে ১০ এপ্রিল অফিস ছুটির পর পুলিশ ডেকে এনে ৫৪ জনকে চাকরিচ্যুতির নোটিশ ধরিয়ে দেওয়া হয়। খুলনার কারখানায়ও একই দিন অফিস শেষের এক ঘণ্টা আগে নোটিশ টানিয়ে ৪৫ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়টি জানানো হয়। ঢাকা অফিসের বেশিরভাগের মোবাইলে অস্বাভাবিক লেনদেনের মেসেজ যায়, পরে খোঁজ নিয়ে তারা জানতে পারেন, তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
অফিসিয়াল নোটিশ ও চাকরিচ্যুতিপত্রে উল্লেখ করা হয়— ‘প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবলের কারণে শ্রম আইনের ধারা-২৬ অনুযায়ী ১০ এপ্রিল থেকে টারমিনেশন করা হলো।’ অথচ এদের অনেকেই প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী কর্মী, দীর্ঘদিন ধরে তারা চাকরি করে আসছিলেন।
যাদের পারফরম্যান্স ভালো না। রিপোর্ট আছে। তাদের আমরা কাট করি। এ পর্যন্ত চারশ’র মতো আপাতত বাদ দিয়েছি। অতিরিক্ত তো তিন হাজার। সবাইকে বাদ দেওয়ার টার্গেট নেই। যাদের কাজে লাগানো যায়, রাখবো।- এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আ. সামাদ মৃধা
প্রতিষ্ঠানটির চাকরিচ্যুত সহকারী বিক্রয় কর্মকর্তা রাফিউল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘কী কারণে টারমিনেশন করা হয়েছে জানি না। টারমিনেশন লেটারও পাইনি। গত মাসের ১০ তারিখ আমাদের বৈশাখী ভাতা দেওয়া হয়। অ্যাকাউন্টে মোবাইলে টাকা জমার মেসেজ আসে। দুপুরে ডিউটি শেষ করে আসার পথে শুনেছি আজ অনেক মানুষের চাকরি যাবে। টারমিনেশন লেটার দেবে।’
বের হওয়ার সময় অনেক পুলিশ সদস্য দেখেছেন জানিয়ে বলেন, ‘আমি ভাবছি হয়তো টোল দেবে, এজন্য পুলিশ আনছে। আমি দুপুরে বের হই। বিকেলে বাসায় এসে দেখি, আরেকটা মেসেজ। খুলে দেখি যে চার বেসিকের টাকা। ভাবলাম, এখন তো সেলারি দেওয়ার কথা না। তার মানে যাদের চাকরি গেছে তাদের দিয়ে দিয়েছে! আমি বিভাগের একজনকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, আমরা তো জানি না। তবে অনেকের এমন মেসেজ আসছে। পরে অ্যাকাউন্টসের একজনকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, হ্যাঁ তোমার যে অবস্থা আমারও একই অবস্থা। তার মানে যাদের টারমিনেশন দিয়েছে, তাদের অ্যাকাউন্টে এরকম অতিরিক্ত টাকা ঢুকছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অ্যাকাউন্টসের যাকে টারমিনেশন করেছে, তাকে কাগজ দিয়েছে। আমি পাইনি। অফিসে যেতে চাচ্ছি, না করছে। বলছে, এখন আইসেন না। পরে আসেন। আমি বলেছি, আমার কাগজপত্র তো আনতে দেবেন। তারা অনুমতি দিচ্ছেন না। একই দিনে সারাদেশের মোট ৪শ জনের চাকরি গেছে। ঢাকায় দুইশ’র বেশি লোকের চাকরি গেছে।’
প্রতিষ্ঠানটির সহকারী মার্কেটিং অফিসার রায়হান বলেন, ‘১০ তারিখ টাকার মেসেজ দিয়ে আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এরপর আর অফিসে যেতে দিচ্ছে না। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে টারমিনেশন লেটার পেয়েছি। সেখানে একটা ধারা উল্লেখ করে লিখেছে, অতিরিক্ত জনবলের কারণে কর্মী ছাঁটাই করা হচ্ছে।’
তার প্রশ্ন, ‘আমরা অতিরিক্ত হই কীভাবে? আমাদের পরে যারা জয়েন করেছে বা যাদের নামে অনেক নোট আছে, তারা তো দিব্যি অফিস করছে। আমাদের নামে তো কোনো নোট নেই। আমরা স্থায়ী। আমাদের সিস্টেম মেনে নিয়োগ দিয়েছে। ফ্রেশ নিয়োগ। যারা পরে জয়েন করছে, মাস্টার রোলে বা অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ হয়েছে, তাদের চাকরিচ্যুত করার কথা। অথচ আমাদের ফ্রেশদের বাদ দিচ্ছে।’
বিষয়টি আমাদের নলেজে এসেছে। আমরা একটা কমিটি করে দিচ্ছি। ওই কমিটি সবার অভিযোগ শুনবে এবং এ বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরবে। এরপর করণীয় নির্ধারণ করা হবে।- স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ও এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. সাইদুর রহমান
ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে রায়হান বলেন, ‘যারা শ্রমিক, তাদের জন্য শ্রমিক আদালত আছে। তারা ব্যবস্থা নিলে লাভবান হবে। আমরা তো অফিসার। আমাদের কিছু করতে চাইলে হাইকোর্টে যেতে হবে, ফলপ্রসূ হবে কি না জানি না। তাই ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে দোলাচলে আছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মোটামুটি অফিসজুড়েই এখন এই ছাঁটাই আতঙ্ক। বিশেষ করে, সন্ধ্যায় মোবাইলে মেসেজ পেলেই আঁতকে ওঠেন তারা।’
এ নিয়ে এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আ. সামাদ মৃধা বলেন, ‘আগের রিজিম অনেক লোক বেশি দিয়ে গেছে। সেটা আমরা যাচাই-বাছাই করছি, আসলে বেশি লোক কোথায় কোথায় আছে। ওই লোকদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি। কাজে না লাগাতে পারলে তখন তাদের বিষয়টি মূল্যায়ন করি। তাদের প্রোফাইল দেখি।’
‘কাজ কেমন, পারফরম্যান্স কেমন? দুর্নাম আছে কি না, মেয়েঘটিত কোনো ব্যাপার আছে কি না, দুষ্টু প্রকৃতির কি না, ঘুরে ফিরে বেড়ায়, হামকি ধমকি দিয়ে চলে, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে, কিন্তু কাজ করে না, এরকম ক্রাইটেরিয়া দেখি। যদি দেখি ওই লোক ওই বিভাগের জন্য দরকার নেই, তখন নিয়ম অনুযায়ী তাকে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আপাতত বাদ দিচ্ছি। তবে ভবিষ্যতে যদি প্ল্যান্ট আরও এক্সপান্ড করতে পারি, তাহলে প্রায়োরিটি থাকবে, তাদের আবার নিয়ে নেওয়ার।’
তিনি বলেন, ‘বাদ কজন দেবো, এটা লিস্ট করা নেই। এটা এমন যে, হয়তো এ মাসে বা আগামী মাসে আমি ইভালুয়েট করলাম এই সেকশনে আমার এত লোক দরকার নেই। এখানে পাঁচজন লোক বেশি আছে। তারা কারা? যাদের পারফরম্যান্স ভালো না। রিপোর্ট আছে। তাদের আমরা কাট করি। এ পর্যন্ত চারশ’র মতো আপাতত বাদ দিয়েছি। অতিরিক্ত তো তিন হাজার আছে। সবাইকে বাদ দেওয়ার টার্গেট নেই। যাদের কাজে লাগানো যায়, রাখবো।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ও এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নলেজে এসেছে। আমরা একটা কমিটি করে দিচ্ছি। ওই কমিটি সবার অভিযোগ শুনবে এবং এ বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরবে। এরপর করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’