নেপালকে সেনাবাহিনীর হাতে যাওয়া যেভাবে আটকেছিলেন রাষ্ট্রপতি
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:১০ অপরাহ্ন | আন্তর্জাতিক

নেপালে ৯ সেপ্টেম্বর রাতে ব্যাপক গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, যার মধ্যে রাজতন্ত্র ফিরে আসার জল্পনাও ছিল। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌড়েলের পদত্যাগের ব্রেকিং নিউজ পর্যন্ত চালিয়েছিল। কাঠমান্ডুর সিনিয়র সাংবাদিক কিশোর নেপাল বলেন, মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) যখন কাঠমান্ডুর বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন মনে হচ্ছিল নেপাল আবারও রাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি দাবি করেন যে, সেদিন সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতি পৌড়েলকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রপতি বিচক্ষণতা দেখান। অন্য কিছু সূত্র অবশ্য বলছে যে, সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি যৌথভাবে পরিস্থিতি সামলিয়েছেন। কিশোর নেপাল জানান, সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে বললে তিনি বলেন, 'আমি পদত্যাগ করব না। আপনি বরং আমাকে খুন করে দিন আর জেন জি-র আন্দোলনকারীদের ওপর হত্যার দায় চাপিয়ে দিন। এরপর আপনি যা করার করবেন।'
কিশোর নেপাল বিবিসিকে তার সূত্রের নাম না জানালেও বলেন, প্রধানমন্ত্রী ওলিও সেনাপ্রধানের কথায় পদত্যাগ করেছিলেন এবং একই ধরনের চাপ রাষ্ট্রপতির ওপরও ছিল। তিনি বলেন, যদি রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতেন, তাহলে নেপাল হয় সামরিক শাসন, নয়তো রাজতন্ত্রের দিকে চলে যেত। তবে নেপালের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল বিনোজ বস্নেত এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তার মতে, সেনাপ্রধান এবং রাষ্ট্রপতি একযোগে একটি সমাধানের পথ খুঁজে বের করেছেন, কারণ কঠিন পরিস্থিতি থেকে দেশকে বাঁচাতে সেনাবাহিনীকে কখনো কখনো সামনে আসতে হয়।
সিনিয়র সাংবাদিক কনক মণি দীক্ষিতও রাজতন্ত্র নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'গণতন্ত্রের প্রতিটা স্তম্ভই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু রাজকীয় প্রাসাদ নারায়ণহিতি এবং জ্ঞানেন্দ্রর বাসভবনে কেউ হাত পর্যন্ত দেয়নি।' তিনি মনে করেন যে, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিশোর নেপাল বলেন, 'নেপালের সংকট এখনো কাটেনি। দুটি বিকল্প ছিল: হয় রাষ্ট্রপতিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একমত হতে হত, অথবা সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রপতির মতামত মেনে নিতে হত।'নেপালের পরিচিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিকে লালও আন্দোলনের পরে রাষ্ট্রপতির ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির ওপর প্রবল চাপ ছিল, কিন্তু তিনি সরাসরি সংসদ ভেঙে দিতে চাননি। তাই তিনি অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ পাওয়ার পর সংসদ ভেঙে দেন। রাকশা বম, যিনি জেন জি-র আন্দোলনের একটি অংশের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি জানান যে, সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে, তারা বেসামরিক সরকার চান বলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করবেন। বম বলেন, যদি রাষ্ট্রপতি বিচক্ষণতা ও সাহস না দেখাতেন, তাহলে নেপাল হয় সামরিক শাসন, নয়তো রাজতন্ত্রের হাতে চলে যেতে পারত।
আন্দোলনের সময় সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের ঘটনা নিয়ে রাকশা বম বলেন যে, তার এটা একেবারেই পছন্দ না এবং ৯ সেপ্টেম্বরের আন্দোলন 'হাইজ্যাক' হয়ে গিয়েছিল। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে জড়িত ইন্দিরা অধিকারীও স্বীকার করেন যে, রাষ্ট্রপতি বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন, না হলে নিয়ন্ত্রণ হাতের বাইরে চলে যেত। তিনি জানান, জেন জি-র সঙ্গে আলোচনার সময়ে সেনাপ্রধান রাজতন্ত্রের সমর্থক দুর্গাপ্রসাই এবং রবি লামিছানের দল আরএসপি-কেও ডেকেছিলেন, যা তাদের আতঙ্কিত করেছিল। ইন্দিরা অধিকারী বলেন, 'আন্দোলন তো জেন জি-র ছিল, কিন্তু সেনাবাহিনী রাজতন্ত্রের সমর্থকদেরও কেন আলোচনায় ডেকে নিল?' তিনি মনে করেন, সুশীলা কারকিকে প্রধানমন্ত্রী বানানোটা রাজতন্ত্রের সমর্থকদের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল।
কনক মণি দীক্ষিতের মতে, নেপালের সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি এবং নির্বাচনের সময়মতো অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে অনেকেই নিশ্চিত নন। তিনি বলেন, 'যখন সিস্টেম এই ব্যাপারে আশ্বস্ত হবে যে নতুন নেতৃত্ব বাকিদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে, ভোটটা তখন হবে।' এদিকে, কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন শাহের প্রভাব অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনিই সুশীলা কারকির নাম প্রস্তাব করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিকে লাল বলেন, বালেন শাহ রাষ্ট্রপতিকে উপেক্ষা করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনার কথা বলেছেন, যা থেকে বোঝা যায় 'পর্দার আড়ালে অন্য কোনো খেলা চলছিল।' তিনি বালেন শাহকে 'একটা মুখোশ' বলে অভিহিত করেন, যার নিয়ন্ত্রকরা দেশের ভেতরে এবং বাইরে উভয় স্থানেই রয়েছে। ইন্দিরা অধিকারী মনে করেন, বালেন শাহের সমর্থন ছাড়া সুশীলা কারকির পক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হওয়া অসম্ভব ছিল। সুশীলা কারকির প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে কিছু প্রশ্নও উঠেছে, কারণ নেপালের সংবিধান অনুযায়ী প্রতিনিধি সভার সদস্য না হলে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না। নেপালের প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার নীলকণ্ঠ উপ্রেতি বলেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পুরো প্রক্রিয়াটাই অসাংবিধানিক হলেও সমাধানের কোনো সাংবিধানিক উপায়ও ছিল না। নেপালের তিনটি বড় রাজনৈতিক দল—নেপালি কংগ্রেস, কেপি ওলির নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (একীভূত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) এবং পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ডার নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী কেন্দ্র)—সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং সুশীলা কারকিকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোর সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক বলে মন্তব্য করেছে। সুশীলা কারকি আগামী বছর ৫ মার্চ নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও অনেকেই মনে করছেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিপিন অধিকারী মনে করেন, এই প্রক্রিয়াতে সংবিধানকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং জনপ্রিয় আন্দোলনের চাপে সব কিছু করা হচ্ছে, যা একটি খারাপ প্রবণতা। তিনি বলেন, 'সমাধানের পথ তো সংবিধানের মধ্যে থেকেই খুঁজতে হবে, তার বাইরে গিয়ে নয়।'