‘বিজ্ঞানী হত্যা করে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়’
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ১০:২০ পূর্বাহ্ন | আন্তর্জাতিক

ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে যুক্ত অন্তত ১৪ জন শীর্ষ বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে ইসরায়েল—এমন দাবি করেছেন ফ্রান্সে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত জোশুয়া জারকা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে বিজ্ঞানী হত্যা করে কর্মসূচি সাময়িকভাবে থামানো গেলেও তা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি বার্তা সংস্থা এপি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত জারকা বলেন, বিজ্ঞানীদের হত্যা ইরানের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ‘প্রায় অসম্ভব’ করে তুলেছে। ইসরায়েলের বিমান হামলার পরও যদি কোনো পরমাণু অবকাঠামো টিকে থাকে, তাতেও বিজ্ঞানী দল নিশ্চিহ্ন হওয়ায় প্রকল্পটি কয়েক বছরের জন্য পিছিয়ে গেছে। তবে পরমাণু বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের হাতে এখনও বিকল্প বিজ্ঞানী রয়েছেন, যারা এই শূন্যতা পূরণ করতে সক্ষম।
ইউরোপীয় দেশগুলো মনে করছে, কেবল হামলা চালিয়ে ইরানের পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংস করা যাবে না। তাই তারা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চায়। ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি হাউজ অব কমন্সে বলেন, কয়েক দশকের জ্ঞান কোনো হামলা মুছে ফেলতে পারে না, আর কোনো শাসকগোষ্ঠীর সেই জ্ঞানকে অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করার ইচ্ছাও বদলাবে না।
ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত জানান, নিহত ১৪ জনের মধ্যে ৯ জনকে ১৩ জুনের প্রথম হামলায় হত্যা করা হয়। তারা পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ধাতুবিদ্যা ও বিস্ফোরক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। বেঁচে যাওয়া আরেক বিজ্ঞানী মোহাম্মদ রেজা সিদিঘি সাবেরও পরে মারা যান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের দীর্ঘদিনের পরমাণু কর্মসূচি ও পশ্চিমাদের অভিযোগ অনুযায়ী গোপনে অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা দেশটিকে শক্ত ভিত দিয়েছে। ফলে তাদের হাতে এখনও এমন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তি আছে, যা দিয়ে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে বসানোর মতো ওয়ারহেড তৈরি করা সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক ও পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বিশ্লেষক মার্ক ফিটজপ্যাট্রিক বলেন, ইরানের নকশা ও পরিকল্পনা অক্ষত থাকবে এবং নতুন গবেষকরা সহজেই তা রপ্ত করতে পারবে। হামলা প্রকল্পকে দেরি করাতে পারে, কিন্তু বন্ধ করবে না। তার মতে, দ্বিতীয় সারির বিজ্ঞানীরাও শেষ পর্যন্ত কাজ শেষ করবে।
ইরানের কর্মসূচি কত দ্রুত পুনরায় গতি পাবে, তা নির্ভর করছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইউরেনিয়াম মজুত ও উৎপাদন ক্ষমতা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার ওপর।
রাশিয়ান বিশ্লেষক পাভেল পডভিগ বলেন, মূল বিষয় হলো ইউরেনিয়ামের মতো উপাদান হাতে থাকা। উপাদান থাকলে বাকি কাজ তুলনামূলক সহজ। তার মতে, বিজ্ঞানী হত্যার মাধ্যমে ভয় দেখানোর কৌশল নেওয়া হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই প্রকল্পে যুক্ত হতে না চায়। তবে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এভাবে কি পদার্থবিদ্যা পড়া ছাত্রদেরও হত্যা করা হবে? এটি বিপজ্জনক পথ।
রাষ্ট্রদূত জারকার দাবি, এই হত্যাকাণ্ড দেখে ভবিষ্যতে যারা এই প্রকল্পে কাজ করতে চাইবে, তারা দুবার ভাববে।
ইরানি বিজ্ঞানী হত্যায় ইসরায়েলের হাত থাকার অভিযোগ বহুদিনের। তবে এবারই তারা সরাসরি দায় স্বীকার করেছে। ২০২০ সালে শীর্ষ বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ হত্যার জন্যও তেহরান ইসরায়েলকে দায়ী করেছিল।
প্যারিসভিত্তিক বিশ্লেষক লোভা রিনেল বলেন, বিজ্ঞানী হত্যার ফলে কর্মসূচি কিছুটা বিলম্বিত হলেও ইরান তা বন্ধ করেনি। তাই এটি কার্যকর সমাধান নয়।
রাষ্ট্রদূত জারকা অবশ্য বলেন, এই ধরনের ‘দুর্ঘটনা’ না ঘটলে ইরান অনেক আগেই বোমা তৈরি করে ফেলত। এখনো তারা সফল হয়নি, আর প্রতিটি ‘দুর্ঘটনা’ প্রকল্পকে কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বেসামরিক নাগরিক হত্যা নিষিদ্ধ। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজ্ঞানীরা যদি ইরানি সামরিক বাহিনীর অংশ হন বা সরাসরি যুদ্ধে যুক্ত থাকেন, তবে তাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নাও হতে পারে।জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন আর. ডেভিড বলেন, এই বিজ্ঞানীরা এমন শাসকের পক্ষে কাজ করছিলেন, যারা ইসরায়েলকে ধ্বংসের হুমকি দিয়েছে। তাই তারা বৈধ লক্ষ্যবস্তু। তিনি নাৎসি জার্মানি ও জাপানের উদাহরণ টেনে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শত্রুপক্ষও এমন বিজ্ঞানী হত্যায় পিছপা হতো না।মানবাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ লরি ব্ল্যাংক বলেন, ইসরায়েলের হত্যাকাণ্ড কতটা বৈধ, তা এখনই বলা কঠিন। কারণ বিজ্ঞানীদের কর্মকাণ্ড ও গোয়েন্দা তথ্য বাইরে থেকে জানা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রদূত জারকা বলেন, পদার্থবিদ্যা শেখা আর তা ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহারের জন্য বোমায় রূপান্তর করা এক জিনিস নয়। এই বিজ্ঞানীরা তা জানতেন এবং আরও উন্নত করছিলেন বলেই তারা ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন।