বুকপকেটে প্রবাসী স্বপ্ন গোধূলির আলোয়
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ০১:২০ অপরাহ্ন | ভিন্ন খবর

রাসেল মোহাম্মদ :
ইতালির পাদোভা শহরের আকাশে তখন গোধূলির রঙ। সন্ধ্যার আলো ঠিক সূর্যের শেষ স্পর্শটুকু ছুঁয়ে আছে, অথচ চারপাশে নেমে আসছে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত নরম ছায়া। আমরা তখন কয়েকজন মিলে হেঁটে চলেছি—হাতে একটি স্মারকলিপি, মনে কিছু কথা। জোরে বলার মতো নয়, তবু বলতেই হবে। বলছি গত ২৬ জুলাইয়ের গল্প।
আমরা কেউ নেতার সাজে আসিনি, এসেছি কথা বলতে। নিজেদের অভিজ্ঞতা আর আশাভরসার কিছু কথা পৌঁছে দিতে চেয়েছি রাষ্ট্রের একজন প্রতিনিধির কাছে। শুধু নিজের জন্য নয়, প্রবাসে থাকা হাজারো মানুষের হয়ে বলতে চেয়েছি। যারা দিনের পর দিন হিমশীতল বাস্তবতায় নিজের দেশের সেবার অপেক্ষায় থাকে।
আমাদের সঙ্গে কেউ মিলান থেকে, কেউ ভেনিস থেকে, কেউবা পাদোভার পাশের শহর থেকে এসেছে। সবাই কোনো না কোনো সময় কনসুলেট সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছে। অনেকে অ্যাপয়েন্টমেন্টই পায় না, অনেকে আবার দূর থেকে এসে ফিরে যায় খালি হাতে। কারো মনে জমে থাকা ক্ষোভ, কারো মনে নিরব হতাশা।
আমরা সব কথা একসাথে সাজিয়ে স্মারকলিপিতে লিখে এনেছিলাম। সেটার পাতায় শুধু সমস্যার তালিকা নয়, ছিল কিছু প্রস্তাব, কিছু আবেদন। আমরা বলেছি, নতুন আরও দুটি কনসুলেট সেবা কেন্দ্র দরকার, যেন দূরের প্রবাসীদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। আর চেয়েছি ভোটাধিকার, কারণ নাগরিকত্ব মানে কেবল পাসপোর্ট নয়।
বাংলাদেশ কনসুলেট মিলানের কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ রফিকুল আলম আমাদের আন্তরিকভাবে সময় দিলেন। আমরা একটা একটা করে কথা বললাম, কোনো তড়িঘড়ি বা উত্তেজনা ছাড়াই। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, মাঝে মাঝে প্রশ্নও করলেন। কোথাও কোনো অহংকার বা অনাগ্রহ ছিল না, বরং একটা মানবিকতা টের পাওয়া যাচ্ছিল।
আমরা বলেছিলাম, প্রবাসে যদি কেউ মারা যান, তাঁর মরদেহ যেন দেশে পাঠানো যায় সহজ নিয়মে। ওয়েজ আর্নার কার্ডসহ নানা কাগজপত্রের জটিলতা যেন এই শেষ সময়ের পথে বাধা না হয়। তিনি বললেন, “এই বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করব উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।” তার কণ্ঠে আন্তরিকতা ছিল, যা আমাদের আশা জাগায়।
আলাপ শেষে আমরা নিচে নামলাম সিঁড়ি বেয়ে। বাইরে তখন গোধূলি একটু একটু করে রাতের দিকে এগোচ্ছে। বাতাস হালকা ঠান্ডা, আর পাদোভার বাতাসে যেন একটা নরম প্রশান্তি মিশে আছে। চারপাশে শহরের আলো জ্বলে উঠছে একে একে।
আমাদের ফেরার সময় হয়তো কেউ কিছু বলছিল না, তবুও একটা অনুভূতি সবার চোখেমুখে ছিল। মনে হচ্ছিল, অন্তত আজ কেউ আমাদের কথা শুনেছে। আমরা যেটা বলতে এসেছি, সেটা শুধু একটা কাগজে লেখা শব্দ নয়, জীবনের বাস্তব গল্প। আর এই গল্পগুলো পৌঁছে গেছে সেই টেবিল পর্যন্ত, যেখান থেকে কিছু একটা বদলানো সম্ভব।
প্রবাসে থাকা মানুষরা শুধু অর্থ পাঠায় না, তারা দেশের ভালোবাসা বহন করে। তারা দেশের পতাকাকে নীরবে উচ্চতায় রাখে প্রতিদিন। তাদের কথা রাষ্ট্রের কানে পৌঁছানোটা খুব জরুরি। আর সে কাজটিই আমরা চেষ্টা করেছি শান্তভাবে, নির্ভরতায়।
একটা বিকেল হয়তো খুব বড় কিছু বদলায় না। তবুও কিছু কিছু বিকেল শুরু হতে পারে বড় কোনো পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে। এই গোধূলি ছিল ঠিক তেমন এক বিকেল—যেখানে কিছু মানুষ মিলে কিছু বলেছে, আশা করেছে, আর অপেক্ষা রেখে গেছে। একটা সুন্দর আগামী দেখতে চাওয়ার মতো নিরীহ কিন্তু দৃঢ় একটা প্রচেষ্টা।
লেখক, এ্যাক্টিভিস্ট ও রাজনীতিক