হোসেন বখতের রাজনৈতিক দর্শন ও আত্মত্যাগ

 প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৩, ০৬:১২ পূর্বাহ্ন   |   ভিন্ন খবর

হোসেন বখতের রাজনৈতিক দর্শন ও আত্মত্যাগ


::শামসুল কাদির মিছবাহ::

পৃথিবীতে যুগে যুগে কিছু ক্ষণজন্মা ব্যক্তির জন্ম হয় আজীবন যাঁরা মানুষকে দিয়েই যান। হোসেন বখত ছিলেন তাঁদেরই একজন। ভাষার জন্য আন্দোলন করেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকায় থাকার পরও নিজেকে জাহির করতে চাননি। সবসময় থেকেছেন পর্দার আড়ালে। বঙ্গবন্ধুর একান্ত আস্থাভাজন হোসেন বখত স্বাধীনতার পর চাইলেই এমপি হতে পারতেন, কিন্তু ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। স্বাধীনতা উত্তর সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার পরও পদ-পবদীতে নিজে আসীন হননি। অন্যের জন্য পথ তৈরি করে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার এই বিরল দৃষ্টান্ত হোসন বখতই রেখে গেছেন। জীবদ্দশায় যে উচ্চতায় থেকে মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন, চাইলেই নিজের জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন। পার্থিব চাওয়া পাওয়ার মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। হোসেন বখতের রাজনৈতিক দর্শন ও আত্মত্যাগ চিরভাস্বর হয়ে থাকবে ইতিহাসে স্বমহিমায়।

সুনামগঞ্জ শহরের আরপিননগরস্থ তালুকদার বাড়িতে ১৯২৫ সালের ৬ জুন তাঁর জন্ম। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকায় গ্রেফতার হন। বছর তিনেক পর মুক্তি পেলেও অল্প দিনের ব্যবধানে   আবারও যেতে হয় কারাগারে। রাজনীতির কারণে তাঁকে আরও তিনবার কারাগারে যেতে হয়।  যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। তখন থেকে প্রতিটি গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে পরিণত হন সুনামগঞ্জ জেলার একজন প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে। তাঁর দুরদর্শী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রজ্ঞা বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিগোচরে আসে। ফলে বাঙালির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন হোসেন বখত।

১৯৬৯ সালে ছাত্র-গণঅভ্যূত্থানেও সুনামগঞ্জের অন্যতম প্রধান নেতা হোসেন বখত। বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তির পর সুনামগঞ্জে প্রথম জনসভা করেন।সেই সময় হোসেন বখতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু একান্তে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। তখনকার সময় এখানে আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত ছিল না। সেইজন্য সিলেট হতে দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী  কমিটি গঠনের জন্য সুনামগঞ্জে আসেন। আফাজ উদ্দিন সাহেবের দোকানে সভা আহ্বান করা হয়। সভায় অংশগ্রহণকারীরা হোসেন বখতকে সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি করার মত প্রকাশ করেন। কিন্তু দায়িত্ব নিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন হোসনে বখত।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন হোসেন বখত। সংগঠকের ভূমিকায় থেকেও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার স্বপক্ষে যুদ্ধ করার কারণে পাকিস্তানি বাহিনী গুড়িয়ে দিয়েছে তাঁদের বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাস্তুহারায় পরিণত হন তাঁরা। সেই অবস্থায়ও রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন কোনরকম সরকারি সহায়তা ছাড়াই। সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় থাকার পরও সরকারি সুযোগ সুবিধা হাতের কাছে পেয়ে তা নিজের কাজে না লাগিয়ে সততার অগ্নিপরীক্ষা দিয়েছেন। সুনামগঞ্জ মহুকুমা প্রশাসক পুর্নবাসনের জন্য তাঁকে সহায়তার প্রস্তাব দিলে, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। বলেছেন, তাঁর থেকে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষও রয়েছেন। তাঁদের যেন সাহায্য করা হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ঢাকায় মিরপুরে বাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। সেই প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছেন একই কথা বলে। এমন নির্লোভ চরিত্রের কারণে হোসেন বখত জনমানুষের অন্তরে চিরস্থায়ী আসনে বসে আছেন। এই জন্য তিনি নেতাদের নেতা এবং সততার আদর্শিক রাজনীতির প্রবাদপুরুষ।

ক্ষণজন্মা এই কিংবদন্তি পুরুষ ১৯৭৩ সালের ২ মার্চ সিলেট মেডিকেল কলেজে রাত ১০.১৫ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। রেখে গেছেন আত্মত্যাগের আদর্শিক এক মহিমাময় ইতিহাস। ঘুণে ধরা আত্মকেন্দ্রীক রাজনীতির এই জামানায় হোসেন বখতের জীবন থেকে আত্মত্যাগের চবক নেয়া খুবই জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার

ভিন্ন খবর এর আরও খবর: