প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৩৬ পূর্বাহ্ন | মতামত

কামাল উদ্দিন মজুমদার :
গত ৫ই সেপ্টেম্বর প্রতিবেশি এবং বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানায় ভারত। তিনি চার দিনের সফরে নয়াদিল্লি যান এদিন। এই সফরে তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। দেখা করেন প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদী মুর্মু’র সঙ্গেও। এই সফরে ভারতের সঙ্গে সাতটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশের। যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয় তার মধ্যে আছে, কুশিয়ারার পানি, মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহযোগিতা, বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যপ্রযুক্তিগত সহযোগিতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহযোগিতা এবং প্রসার ভারতী ও বিটিভি’র মধ্যে সহযোগিতা।
৬ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষর হওয়া সাত সমঝোতার মধ্যে কুশিয়ারা নদী থেকে বাংলাদেশ কর্তৃক ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের বিষয়টিকে সবথেকে বেশি স্বাগত জানিয়েছে ঢাকা। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির পর এই প্রথম দুই দেশের মধ্যে এ ধরণের কোনো চুক্তি হলো। এই চুক্তি সিলেট অঞ্চলের জন্য আশির্বাদের মতো এবং ঢাকার উদ্বেগ কমাতে এটি বেশ সাহায্য করবে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে থাকা যৌথ কোনো নদীতে এ ধরণের একটি চুক্তি বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের প্রধান অগ্রাধিকার ছিল। ভাটিতে থাকা বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই পানি সংকটে ভুগছিল।
এর আগে ২০১০ সালে ভারত ও বাংলাদেশ তিস্তা নিয়ে একটি চুক্তি চূড়ান্ত করেছিল।
কিন্তু সেসময় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রধান মমতা ব্যানার্জীর কারণে এটি চুক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারেনি। কুশিয়ারায় চুক্তির কারণে ভারতের আসাম রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চল এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের মানুষেরা লাভবান হবেন। রহিমপুর খাল দিয়ে ১৫৩ কিউসেক পানি আনা হলে তা শুষ্ক মৌসুমে জকিগঞ্জ উপজেলার মানুষের কৃষিকাযে সুবিধা নিয়ে আসবে। আবার কানিঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলার মানুষও উপকৃত হবেন।
দুই নেতা যোগাযোগ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং পরমাণু শক্তি নিয়েও আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের এনার্জি সংকট মোকাবেলায় রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিটের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা ও মোদি। এই প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত। এটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বাংলাদেশের মানুষ কমদামে বিদ্যুৎ পাবে।
উভয় নেতা সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা নিয়েও আলোচনা করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আজ সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করেছি। ১৯৭১ সালের সেই চেতনা জাগ্রত রাখতে আমাদেরকে অবশ্যই সেইসব শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে যারা আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাসকে নষ্ট করতে চায়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে ভারত বন্যার পানি সংক্রান্ত তথ্য দেয়ার সময়সীমা বৃদ্ধি করেছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ‘রূপসা রেল সেতু’ উদ্বোধন করেন ভারত ও বাংলাদেশের সরকার প্রধান। ৬৪.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ খুলনা-মংলা ব্রডগেজ রেল প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই ৫.১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রূপসা রেল সেতু। এরফলে প্রথমবারের মতো মংলা বন্দর ও খুলনা শহর রেলপথে যুক্ত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে মংলা বন্দর।
আরও ঘোষণা করা হয়েছে যে, ভারত ২৫টি প্যাকেজে সড়ক নির্মাণ সামগ্রি ও যন্ত্রপাতি বাংলাদেশের হাইওয়ে ডিপার্টমেন্টকে সরবরাহ করবে। খুলনা-দর্শনা রেল প্রকল্পও এসময় ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করে বর্তমানে থাকা অবকাঠামো আরও উন্নত করা হবে এবং আন্তসীমান্ত রেল চলাচল চালু সম্ভব হবে। এতে ব্যয় হবে ৩১২.৪৬ মিলিয়ন ডলার। আবার পর্বতিপুর থেকে কাউনিয়া রেল সড়কও ডুয়েল গেজে রূপান্তর করা হবে, যাতে ব্যয় হবে ১২০.৪১ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্প বাংলাদেশের বিরল ও ভারতের রাধিকাপুরকে যুক্ত করবে এবং দুই দেশের মধ্যেকার রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে। এসব প্রকল্প বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম যোগাযোগ কেন্দ্রে পরিণত করতে সাহায্য করবে।
এটি উল্লেখ করতে হয় যে, ভারত বাংলাদেশকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৯.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। এই অর্থ দিয়ে খুলনা ও ঢাকার মধ্যেকার রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি করা হবে। দুই দেশের মধ্যেও রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে যার ফলে ভারত-বাংলাদেশ একে অপরের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত থাকতে পারবে।
ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের সবথেকে বড় বানিজ্য সহযোগী রাষ্ট্র। গত অর্থ বছরে দুই দেশের মধ্যে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক বানিজ্য ঘাটতি। এই ঘাটতি কমিয়ে আনতে এবং বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি করতে উভয় পক্ষ ‘কম্প্রিহেনসিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট’ বা সিইপিএ নামের একটি চুক্তি নিয়ে কাজ করছে। এটি বাস্তবায়িত হলে দুই দেশের বাণিজ্য ৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে।
এই সফরে ভারতের শিল্পপতি গৌতম আদানির সঙ্গে দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় ধনী মানুষ। ঝাড়খ- রাজ্যে অবস্থিত একটি ১৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে যাচ্ছে আদানি পাওয়ার। ভারতের ‘প্রতিবেশি প্রথম’ নীতির অধীনে এই প্রকল্পকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে দেশটি।
সবশেষে এই সফরে দেখা গেছে, বাণিজ্য, শক্তি ও জ্বালানী, যোগাযোগ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, এবং নদী ইস্যুর মতো প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া তিস্তা নদীর পানি বণ্টনসহ আরও ইস্যুগুলো সমাধানেও ওই সফর প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। এই সফরের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌছাবে এবং ভবিষ্যতে এই সম্পর্ক আরও গভীর ও গতিশীল হয়ে উঠবে।
(কামাল উদ্দিন মজুমদার: কৌশলগত নিরাপত্তা বিশ্লেষক)