জাতীয় মাছ ইলিশ উৎপাদন, আহরন ও বিক্রয়ে করণীয়
প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:২৫ অপরাহ্ন | মতামত
ইলিশ মাছ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। ইলিশ মাছকে বাংলাদেশে মাছের রাজা বলা হয়। এটি মূলত সামুদ্রিক মাছ। এটি বঙ্গোপসাগর হতে ডিম পাড়ার জন্য পদ্মা ও মেঘনা নদীতে আগমন করে। এ ছাড়াও উপকূলের অন্যান্য নদীতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪টি প্রজনন ক্ষেত্র ও ছয়টি অভয়াশ্রম আছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু করে ভেলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র। বিশেষ করে মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর এগুলো হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট। চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালি, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ে। ইলিশের অভয়াশ্রমগুলো মূলত মেঘনা নদী ও এর অববাহিকা এবং পদ্মা ও মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে চাঁদপুরে মেঘনা নদীর নি¤œ অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলায় মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকা, তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা, পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকা, বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকা।
বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে তৃতীয় এবং ইলিশ মাছ উৎপাদনে প্রথম। ওয়ার্ল্ডফিসের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬% শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। আর ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ১৪% শতাংশ ইলিশ মাছ উৎপাদিত হয়। ১৭ আগস্ট, ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশের ইলিশকে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পন্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, ওয়ার্ল ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পন্যের স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর ওয়ার্ল ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন এর হয়ে কাজ করে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৩৪টি পন্য জিআই পন্য হিসেবে স্বীকৃত। এর মধ্যে ১ম স্থানে রয়েছে জামদানী শাড়ি। আর ২য় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের ইলিশ।
বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির সূত্র মতে দেশে বছরে সাড়ে ৫ লক্ষ থেকে ৬ লক্ষ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এ বছর এখন পর্যন্ত ৫ লক্ষ ৩০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। ইলিশ উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে ভোলা (১ম) ও ২য় স্থানে রয়েছে বরগুনা। এ ছাড়াও চাঁদপুর, বরিশাল, নোয়াখালি, গোয়ালন্দ ও বঙ্গোপসাগরে ইলিশ আহরণ করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৯ সালে প্রথম ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়। এরপর থেকে বাংলাদেশ ইলিশ রপ্তানি করে আসছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, ২০২৯-২০২০ অর্থ বছরে ৪৭৬ টন ইলিশ রপ্তানি হয়। এতে আয় হয় সাড়ে ৩৯ লক্ষ ডলার। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১,৬৯৯ টন ইলিশ রপ্তানি করে আয় হয় ১ কোটি ৬৪ লক্ষ ডলার। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ১,২৩০ টন ইলিশ রপ্তানি করে আয় হয় ১ কোটি ২৪ লক্ষ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ইলিশ রপ্তানি করা হয় ১,৩৯১ টন। এতে আয় হয় ১ কোটি ৩৮ লক্ষ ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৮০২ টন ইলিশ রপ্তানি করে আয় হয় ৮০ লক্ষ ডলার।
এ বছর অন্তর্বর্তী সরকারের বানিজ্য মন্ত্রণালয় ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে শারদীয় দূর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়ে আদেশ জারি করে। পরবর্তীতে তা থেকে সরে এসে বানিজ্য মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত ২ হাজার ৪২০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। এ অনুমতি দেয়া হয়েছে ৪৯টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে। ২০২৩ সালে বিগত সরকার ভারতে ৫০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত ভারতে রপ্তানি করা হয় ৮০২ টন।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছিলেন: চলতি বছর ইলিশ রপ্তানি করা হবে না। দেশের মানুষ ইলিশ খাবে তারপর ইলিশ রপ্তানির কথা বিবেচনা করা হবে। ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে বানিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন: যা-ই বলা হোক ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানি করা হবে। তিনি বলেন: ইলিশ রপ্তানির বিপক্ষে যারা বলে তারা ইমোশনাল। তিনি আরও বলেন, সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্তে ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে। তিনি কাকে ইলিশ দিচ্ছেন, যে সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করছে, দেশের মানুষকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বাধ খুলে দেয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাক্ষাত দিলেও প্রধান উপদেষ্টাকে সাক্ষাত দেয় না, অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য নানা কুটকৌসল আটছে, যে কিনা বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশের জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং এখনো নিচ্ছে। তিনি ইউরোপে ইলিশ রপ্তানি করলে দেশের জনগণ কিছু বলতো না। তিনি দেশের মানুষকে ইমোশনাল বলছেন। দেশের মানুষকে এভাবে তাচ্ছিল্য করে কথা বলা ঠিক হয়নি। ইলিশের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের ইমোশন থাকবেই। এটা স্বাভাবিক। কেননা দেশের মানুষ তো ঠিকমত ইলিশ খেতে পারছে না। ইলিশ অধিকাংম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দেশে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬৫০ টাকায় আর ভারতে রপ্তানি করা হচ্ছে ১ হাজার ১৮০ টাকায়। চাঁদপরের পাইকারি বাজারে ১ কেজির ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা। আর ১২০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৩০০ থেকে ২৪০০ টাকা। এতো কমে কেন ভারতে ইলিশ রপ্তানি করা হচ্ছে। প্রতি কেজিতে ৪০০ টাকা কম নেয়া হচ্ছে। এ জন্য বানিজ্য উপদেষ্টাকে অবশ্যই কৈফিয়ত দিতে হবে।
এ বছর মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় হতে ইলিশ রপ্তানির কোন অনুমতি দেয়া হয়নি। মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলেছে: এটা তাদের সিদ্ধান্ত না, বরং তাদের আপত্তি থাকার পরও বানিজ্য মন্ত্রণালয় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। বানিজ্য উপদেষ্টা ও বানিজ্য মন্ত্রণালয় একক সিদ্ধান্তে ইলিশ রপ্তানি করা হ¦েচ্ছ। সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা করে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ ছিল।
দেশে রুই, কাতল, মৃগেল, কই, পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, সিলভারকাপ, গ্রাসকাপসহ অনেক প্রজাতির মাছ চাষ হয়। এ সকল মাছ চাষ করার জন্য পুকুর লীজ নিতে হয়, মাছের পোনা ক্রয় করতে হয়, মাছের খাবার কিনে খাওয়াতে হয়, জেলের মাধ্যমে আহরন ও বাজারজাত করতে হয়। এতে মাছ চাষ করতে অনেক টাকা খরচ হয়। এতো খরচ করার পারও এই মাছগুলো বাজারে কেজি প্রতি ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রয় করা হয়।
অথচ ইলিশ মাছ উৎপাদন করতে কোনো টাকা খরচ হয় না। শুধুমাত্র জেলেদের মাধ্যমে আহরন করতে কিছু টাকা খরচ হয়। এ মাছ সরকারিভাবে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আহরন করার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারিভাবে জেলে নিয়োগ দিতে হবে। সরকারের নিয়োগকৃত জেলে ছাড়া অন্য কেউ যাতে ইলিশ আহরন করতে না পারে সেজন্য কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর মাধ্যমে নজরদারী ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। ইলিশ আহরনের পর সরকারীভাবে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশে বছরে সাড়ে ৫ লক্ষ থেকে ৬ লক্ষ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এতো ইলিশ কোথায় যায়। জেলেদের একটি সিন্ডিকেট মাঝ নদী থেকেই ইলিশ ভারতীয় পাচারকারীদের হাতে বিক্রয় করে দেয়। সীমান্ত দিয়ে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ পাচার হয়। ইলিশ চোরাকারবারীদের প্রতিরোধ করতে হবে, আইনের আওতায় আনতে হবে এবং দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দিতে হবে। ইলিশ সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত আছে বিভিন্ন রাজতৈনিক দলের নেতা ও কর্মী। ইলিশের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৬ সালে তাঁর পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে লিখেছিলেন জেলে কুবের সারাদিন পদ্মা নদীতে অনেক পরিশ্রম করে ইলিশ ধরে কিন্তু দিন শেষে সব ইলিশ ইলিশ সিন্ডিকেটের হোতা শেতল বাবু নিয়ে যায়। জেলে কুবের পরিবারের খাওয়ার জন্য একটি ইলিশও বাড়ীতে নিয়ে যেতে পারেনি। সেই উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার ৮৮ বছর পরও ইলিশ সিন্ডিকেটের শেতল বাবুরা এখনও বিরাজমান। ইলিশের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে দেশের জনগণকে কম দামে ইলিশ খাওয়াতে পারবেন না।
আমার মনে পড়ে ছোট বেলায় যখন হাটে যেতাম তখন শুনতাম ইলিশ মাছ বিক্রেতা ডাকতো এক ইলিশ ৩৬ টাকা, এক ইলিশ ৩৬ টাকা। আর আজ ইলিশের দাম আকাশ চুম্বি। ইলিশ মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। অধিকাংশ জনগণ বছরে ১ কেজির ইলিশ চোখে দেখতে পায় না এবং খেতেও পায় না। এটা এ জাতীর জন্য বড়ই লজ্জার বিষয়। এ মাছ উৎপাদনে কোনো খরচ হয় না। এর দাম ২০০ টাকার নিচে হওয়া দরকার। কোন যুক্তিতে প্রতি কেজি ইলিশের দাম ১ হাজার ৬৫০ টাকা আমার বোধগম্য হয় না। এটি মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরো ব্যর্থতা।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জাতির অনেক প্রত্যাশা। এ সরকার অনেক সংস্কার নিয়ে কাজ করছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে ইলিশ সিন্ডিকেট ভাঙ্গার জন্যও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ইলিশ উৎপাদন, আহরন, বাজারজাতকরণ ও ইলিশ সিন্ডিকেট ভাঙ্গার জন্য মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংস্কার প্রয়োজন। এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জাতির প্রত্যাশা যে, সরকার যথাযথ পদক্ষেপ ও সংস্কারের মাধ্যমে দেশের জনগনের জন্য জাতীয় মাছ ইলিশ খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন এবং ইলিশের দাম মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে অর্থাৎ ২০০ টাকার নিচে রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এ জন্য জাতি আপনাদের চিরকাল মনে রাখবে।
লেখক ; মো: মাহবুবুর রহমান, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ