অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সমীপে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এগারো দফা ইশতেহার
প্রকাশ: ২৯ অগাস্ট ২০২৪, ০৯:৫২ অপরাহ্ন | মতামত
মুঃ আবদুল হাকিম
১।অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশনে দুই সচিবের নিয়ন্ত্রণে দুইটি বিভাগ সক্রিয় করতে হবে।একটি হবে নির্বাচন বিভাগ এবং অপরটি হবে রাজনীতি বিভাগ।দেশে পরিচ্ছন্ন ও সুস্থ ধারার রাজনীতি সৃষ্টির জন্য রাজনীতি বিভাগ কাজ করবে।যে সব রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে তাদেরকে যথানিয়মে অবিলম্বে নিবন্ধন দিতে হবে।যারা আবেদন করবে কালবিলম্ব না করে তাদেরকেও নিবন্ধন দিতে হবে।নিবন্ধন আইন এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করতে হবে।রাজনীতিকে আইনী কাঠামো এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলে থিংক ট্যাংক এবং মতাদর্শ থাকা বাধ্যতামূলক করে রাজনীতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক করতে হবে। রাজনীতি নেতা ভিত্তিক হবে না - নীতিভিত্তিক হবে।
প্রয়োজনে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে রাজনীতি আইন প্রণয়ন করতে হবে।নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য সর্বদলীয় সমঝোতা তৈরী করতে হবে।এজন্য বিভিন্ন দল, ছাত্র, অংশীজন এবং পেশাজীবীদের সাথে নিয়মিত সংলাপ অব্যাহত রাখতে হবে।সংবিধানের প্রাথমিক খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দিতে হবে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র শিক্ষকদের উপর।এই খসড়ার ভিত্তিতে সংলাপকে গন্তব্য অভিমুখে এগিয়ে নিতে হবে। সংবিধান সভা এবং সংসদ নামে দুটো আলাদা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। সংবিধান প্রণয়ণ এবং স্ংশোধন করবে সংবিধান সভা। সংসদ সংবিধানের আওতায় আইন প্রণয়ন করবে। সংবিধান সভা জাতির প্রয়োজনে গঠিত হবে। দলের নির্বাহী পদে আসীন ব্যক্তিবর্গ সরকারে থাকতে পারবে না।কোনো পেশাজীবী সংগঠন রাজনৈতিক দলের অংগ সংগঠন হতে পারবে না। সাংবিধানিক শাসন অটুট রাখার জন্য শক্তিশালী সাংবিধানিক আদালত থাকতে হবে।
২. সরকারের সর্বোচ্চ মেয়াদ হবে তিন বছর। ইউপি মেম্বার থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত কাউকে দুই মেয়াদের বেশি নেতৃত্বে যাবার সুযোগ দেয়া উচিৎ না। যোগ্যতা থাকলে আইন করে সবাইকে নেতা হবার সুযোগ দিতে হবে। নাগরিকদের নেতৃত্বে যাবার সুযোগ কে সংবিধানে মানবাধিকার বা মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করতে হবে। নেতৃত্বের মেয়াদ কম হলে অনেক যোগ্য মানুষ নেতা হবার সুযোগ পাবেন।
৩।সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অগণতন্ত্র,স্বৈরতন্ত্র এবং মাফিয়া তন্ত্র উৎপাদনের প্রথম ভ্রুণ। এটি সংস্কার করতে হবে। সরকারী পদে সকল নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা রহিত করতে হবে এবং জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নির্দলীয় রাষ্ট্রপতিকে এ দায়িত্ব ন্যস্ত করতে হবে।এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনী ,র্যা ব, পুলিশ ,আনসার, প্রশাসন,বিচার বিভাগ ,বিশ্ববিদ্যালয় ও গণমাধ্যমকে দলীয়করণ করে। এই অনুচ্ছেদের জন্য পুলিশ প্রধানমন্ত্রীর হুকুমে জনগণের বুকে গুলি চালায়। স্ব স্ব কমিশনকে নির্দিষ্ট আইন ও কমপিটেন্সী ফ্রেমওয়ার্কের ভিত্তিতে যোগ্য ব্যক্তি বাছাই এর দায়িত্ব ন্যস্ত করতে হবে । কমিশনগুলোর যাবতীয় কার্যক্রমকে সাংবাদিকদের কাছে শতভাগ স্বচ্ছ করতে হবে। সাংবিধানিক কমিশনসমূহ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে নির্দলীয় রাষ্ট্রপতির অধীনে ন্যস্ত করতে হবে। এটা করতে পারলে বাংলাদেশ থেকে দলীয়করণ চিরতরে বন্ধ হবে।
৪।সংবিধানের সত্তর অনুচ্ছেদ অগণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র এবং মাফিয়াতন্ত্র উৎপাদনের দ্বিতীয় ভ্রুণ ।এটি সংস্কার করতে হবে ।সাংসদদের সরকারের সমালোচনা করার অধিকার, সরকারী বিলের বিপক্ষে মতামত ও ভোট দেয়ার অধিকার, অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে বদলানোর অধিকার এবং অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে সংসদের কাছে প্রধানমন্ত্রীকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার ক্ষমতা দিতে হবে। ৩০% ভোটার অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট রিকল করলে সংশ্লিষ্ট আসনে আবার ভোট হবে। সাংসদদের বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা, হাঁ বলার স্বাধীনতা, না বলার স্বাধীনতা, মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা ইত্যাদি এই অনুচ্ছেদের মাধ্যমে হরণ করা হয়েছে। অথচ এগুলো প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
৫।মানবাধিকার আদায়ে সকল জেলায় মানবাধিকার আদালত গঠন এবং তাদের রিট মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।আইনজীবীদের ভোটে মানবাধিকার কমিশন গঠন এবং প্রত্যেক বারে তার শাখা অফিস স্থাপন করতে হবে ।
৬।জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি এবং নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচিত হবে। স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থাপনা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সাংবিধানিক স্থানীয় সরকার কমিশনে ন্যস্ত করতে হবে।জেলার ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং বিভাগীয় ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে বিভাগীয় পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবে । জেলা পরিষদের সদস্য সচিব হিসেবে জেলা প্রশাসক এবং বিভাগীয় পরিষদেরসদস্য সচিব হিসেবে বিভাগীয় কমিশনার আইন মোতাবেক দায়িত্ব পালন করবেন। পরিষদগুলো স্বশাসিত প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে বিচার ব্যতীত যাবতীয় কাজ সম্পাদন করবে।পদাধিকার বলে রাষ্ট্রপতিকে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে বহাল রাখতে হবে।সরকারী এবং বেসরকারী সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং একাডেমিক স্বাধীনতা দিতে হবে।বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় রাজনীতি সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।তবে তাদের নির্দলীয়ভাবে রাজনীতি করার অধিকার কেড়ে নেয়া যাবে না।
৭।কর্মসংস্থান না হওয়া অবধি শিক্ষিত যুবকদের বেকার ভাতা প্রদান করতে হবে।বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ছাত্রদের পার্টটাইম জবের মাধ্যমে আয় উপার্জনের বন্দোবস্ত করতে হবে।সামাজিক গবেষণায় তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে , দেশী পণ্যের মার্কেটিং কাজে, আদমশুমারিতে, সম্পদ শুমারিতে, বিভিন্ন জরিপে এবং আয়কর ও ভ্যাট আদায়ে টাকার বিনিময়ে তাদের খন্ডকালীন কাজে লাগানো যায়।
৮।সিনেটের ভোটে মাত্র দুই বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার ও রেজিষ্ট্রার নিয়োগ করতে হবে যাতে যোগ্য আরো অনেক অধ্যাপক অভিষিক্ত হতে পারে।যাতে এ পদগুলোতে এক ব্যক্তি দীর্ঘদিনের জন্য কুক্ষিগত করে না রাখতে পারে।
৯।সাংবিধানিক উচ্চশিক্ষা কমিশনগঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব এ কমিশনে ন্যস্ত করতে হবে। ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা ইত্যাদি পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে পেশাভিত্তিক উচ্চকক্ষ গঠন করতে হবে। এছাড়াও সাংবিধানিক অপরাধ ও দুর্নীতি দমন কমিশন, সাংবিধানিক আদালত,সাংবিধানিক স্থানীয় সরকার কমিশন, সাংবিধানিক তথ্য কমিশন, সাংবিধানিক অডিট কমিশন, সাংবিধানিক পাবলিক সার্ভিস ও জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন গঠন করতে হবে।
১০।সাংবিধানিক অপরাধও দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে থানাগুলোকে ন্যস্ত করতে হবে।দুর্নীতির অভিযোগগুলোও এখানে দায়ের করার বিধান চালু করতে হবে। তবে দুর্নীতি এবং অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়া পৃথক হবে ।আদালতে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে দুর্নীতি লব্ধ অর্থ সরকারে বাজেয়াপ্ত করার বিধান চালু করতে হবে।দুর্নীতিলব্ধ এবং অবৈধ সম্পদের উত্তরাধিকার স্বত্ব বাতিল করতে হবে।
১১।সরকারি চাকুরিতে আবেদনের বয়োসীমা ৪০ এবং অবসরের বয়োসীমা ৬৫ বছর করতে হবে। ভ্যাটকে ৫% এ সীমিত রেখে আয় ও সম্পদ কর বাড়াতে হবে।পোষ্ট অডিট বাতিল করে প্রিঅডিটকে শক্তিশালী করতে হবে।এসএসসি পাশ করলে ছাত্রদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভোটার তালিকাভূক্ত হবার বন্দোবস্ত করতে হবে। তদন্ত ও বিচারের সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। বিদেশে পাচারকৃত অর্থফেরত নিয়ে আসতে হবে।সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য ব্যক্তিমালিকানা সীমিত করার আইন প্রণয়ন করতে হবে।
(মুঃ আবদুল হাকিম, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব )