ঝালকাঠির মেয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রী মেঘার মৃত্যুর সাড়ে চার বছররেও বিচার শেষ হয়নি
প্রকাশ: ০৩ অগাস্ট ২০২৩, ০৬:১৬ অপরাহ্ন | শোক ও মৃত্যুবার্ষিকী

রাজু খান (ঝালকাঠি) : ঝালকাঠির মেয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রী আলোচিত সায়মা কালাম মেঘার মৃত্যুর ঘটনায় সাড়ে চার বছর পার হলেও এখনও বিচার শেষ হয়নি। ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রধান অভিযুক্ত মাহিবী হাসান, তাঁর মা সেলিনা নফিসসহ তিন আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-৭ এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার। অভিযোগ গঠনের পর তিন বছর অতিবাহিত হলেও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে মাত্র চার জনের। গত রবিবার সাক্ষ্য দেন সায়মা কালাম মেঘার বাবা আবুল কালাম আজাদ। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাদি পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট মকবুল হোসেন জানান সাক্ষীদের ১৬১ ধারায় জবানবন্দি, ভিকটিমের স্যুইসাইড নোট, সুরতহাল, ভিসারা রিপোর্ট পর্যালোচনা করে তিন আসামী মাহিবী হাসান, তাঁর মা সেলিনা নাফিস ও বোন নওরিন বন্যার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ঝালকাঠি শহরের পূর্ব চাঁদকাঠি এলাকার বাসিন্দা আবুল কালামের মেয়ে ঢাকা ইডেন কলেজের অনার্স ২য় বষ্যের ছাত্রী সায়মা কালাম মেঘার সাথে ঝালকাঠি শহরের বিআইপি সড়কের মৃত নফিস উদ্দিনের ছেলে বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র মাহিবী হাসানের প্রেম প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দীর্ঘদিন প্রেমের সম্পর্কের পর মাহিবী হাসান ও তাঁর পরিবার বিবাহের প্রস্তাব অস্বীকার করায় গত ২১ এপ্রিল ২০১৯ তারিখ বিকেল ৫টায় সায়মা কালাম মেঘা ঢাকার ধানমন্ডির একটি ভাড়া বাসায় মাহিবীর সাথে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করে। এ ব্যাপারে মেঘার মা রুবিনা বেগম বাদী হয়ে ৩ জনকে আসামী করে ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে মামলা দায়ের করে। আদালতের নির্দেশে পিবিআই তদন্ত করে গত ২০/০৯/২০১৯ তারিখ আদালতে তিন আসামীর বিরুদ্ধে নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(ক) ও ৩০ ধারায় প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদন দাখিলের পর আসামীরা আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইলে আদালত প্রধান আসামী মাহিবী হাসানকে কারাগারে পাঠিয়ে তাঁর মা ও বোনের জামিন মঞ্জুর করেন। দীর্ঘ ছয় মাস পর মাহিবী জামিন লাভ করে। মামলার বাদী সায়মা কালাম মেঘার মা রুবিনা বেগম গত ৫ অক্টোবর ২০২১ আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেন। সাক্ষীতে তিনি বলেন, তাঁর মেয়ে সায়মা কালাম মেঘা ঢাকা ইডেন বিশ^বিদ্যালয় কলেজে সমাজকল্যাণ বিষয়ে অনার্স ২য় বর্সে পড়তো এবং ধানমন্ডির মুক্তা খানের বাসায় সাবলেট থাকতো। মামলার ০১নং আসামী মাহিবী হাসানের সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁদের প্রেম হওয়ার ৭/৮ মাস পর আমি জানতে পারি। আমি মেয়েকে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য বুঝাই। তখন মেঘা বলে “ আম্মু ওর সাথে আমার দৈহিক সম্পর্ক হইছে, ওর কাছ থেকে ফিরে আসার সুযোগ নাই, আমাদের মেহেদী, আলতাপড়ানো হইছে, ও আমার পায়ে আলতা পড়াইয়া কথা দিছে আমাকে বিয়ে করবে, তাই আমি অন্য কাউকে বিয়া করতে পারবো না, আমার বিয়ের জন্য কেনা কাটা করে রাখছে তাই আমি ওকেই বিয়ে করবো”। ঘটনার দিন ২১ এপ্রিল ২০১৯ তারিখ বিকাল ৫.০৯ মিনিটে আসামী মাহিবী আমাকে ফোন করে জানায় যে, “ মেঘা গলায় ফাঁস দিছে” । মাহিবী আমার মেয়ের বান্ধবী আনিকাকেও ফোনে জানায়। তখন আনিকা আমার মেয়ের বাসায় গিয়ে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। আমি যখন পরের দিন ঘটনাস্থলে যাই তখন ঐ বাসার মালিক মুক্তা খান বলেন, “ গতকাল ২১ এপ্রিল মাহিবীর আসার কথা ছিল এবং মেঘাকে বিয়ের কথা ছিল। আমরা মেঘাকে বিয়ের জন্য মেহেদী পড়াই, তারপর মহিবী ফোন করে জানায় সে আনবে না এবং বিয়ে করবে না। এই কথায় অপমানিত হয়ে মেঘা আত্মহত্যা করে। সাক্ষীতে মেঘার মা রুবিনা বেগম আরও বলেন, আত্মহত্যার আগে মেঘা যে সুসাইড নোট রেখে গেছে তাতে ওর মৃত্যুর জন্য মাহিবী, তার মা ও বোনকে দায়ী করে গেছে। সুসাইড নোটে মেঘা লিখেছে, মা আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম, কিন্তু “ মাহিবী এবং ওর মা বোন আমাকে বাঁচতে দিল না”। গত রবিবার(৩০জুলাই) সাক্ষ্যপ্রদান করে মেঘার বাবা আবুল কালাম আজাদ আদালতে বলেন, আমার মেয়ে মেঘার সাথে মাহিবীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল সেটা আমি জানতে পারি মেঘা মারা যাওয়ার তিনচারমাস আগে। প্রেমের ষিয়টি জানতে পেরে আমি ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল আসামীদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমার স্ত্রী ও শ্যালিকাকে পাঠাই। মাহিবীর মা ও বোন মেঘার সাথে আসামী মাহিবীর বিয়ে দিতে অস্বীকার করে। আসামী মাহিবী হাসানই আমার স্ত্রীকে ফোন করে জানায় ঘটনার দিন আমার মেয়ে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছে এবং আসামী মাহিবী হাসান নিজে তা ফেসবুক লাইভে দেখেছে। আসামী মাহিবী হাসানের প্ররোচনায় আমার মেয়ে ফ্যানের সাথে ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করেছে। মাহিবী হাসান ইচ্ছা করলে আমার মেয়েকে বাঁচাতে পারতো। আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, মাহিবী হাসান ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর থেকে মামলা তুলে নেয়ার জন্য অথবা আপোষ করার জন্য নানাভাবে চাপ সৃস্টি করে আসছে। এমন কি আমার নামে মিথ্যা মামলা ও দায়ের করেছে। ০২নং আসামী সেলিনা নফিস বাদী হয়ে আমি ও আমার দুই ছেলে কামরুল হাসান ছনি ও কাওসার হোসেন জনের নামে ঝালকাঠি থানায় একটি নন জিআর ৫৬/১৯ মামলা করেন গত ৩০/১১/১৯ তারিখ। মামলাটি সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে বিচারের জন্য ঝালকাঠি পৌরসভায় পাঠানো হয়। মামলার বাদী নির্ধারিত তারিখে সাক্ষী দিতে না আসায় পৌরসভার মেয়র মামলাটি খারিজ করে দেন।
ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল-৭ এর পিপি আফরোজা ফারহানা আহমেদ অরেঞ্জ বলেন, মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন হওয়ার পর আসামীরা সেই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন দায়ের করেছিল। সে কারণে কিছুদিন মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ ছিল। হাইকোর্ট রিভিশন আবেদন খারিজ করে দিলে আবার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। বাদীসহ চারজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর অবশিস্ট সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।
মোঃ