আগে মানুষ হও,তারপর বাঙালি হলেই চলবে
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২০, ০৪:২৫ পূর্বাহ্ন | মতামত

শ্যামসুন্দর সিকদার:
কেউ এসে যদি ছেলেবেলায় স্পষ্ট করে আমাকে বলতো, ‘আগে মানুষ হও,তারপর বাঙালি হলেই চলবে’।তাহলে বোধ করি ওই বালক বয়সে পথের নিশানাটা সুনিদিষ্ট করে সহজেই পেয়ে যেতাম।অবশ্য মা আমাদের ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে প্রায়ই বলতেন, ‘তোদেরকে মানুষ করার জন্যই তো এত কষ্ট করছি’।তখন ওই “মানুষ” হওয়ার অর্থ বুঝতাম এইভাবে যে, শুধু ভাল করে লেখাপড়া করলেই চলবে।তবে পড়ালেখা করার পাশাপাশি যে অন্যান্য মানবিক গুণাবলী অর্জন করার আদর্শিক বিষয় নিহিত আছে, তা তখন বুঝতাম না।
বয়স বাড়ার সংগে সংগে প্রথমদিকে আদর্শ অনুসরণীয় ছিল বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখের কথা।তখন মনে হতো শিক্ষকগণ যা বলেন , সেটাই সঠিক - সেকথাই সত্য, সেটাই শিরোধার্য্য।তখন কোনো স্যার যদি কোনো অংক ভুল পদ্ধতিতেও শিখাতেন এবং পরে যদি কেউ এসে বলতো এটাতে ভুল আছে , তখন তা মেনে নিতে পারতাম না। কারণ এটাইতো বিদ্যালয়ের স্যার শিখিয়েছেন।তাই এটা ভুল হতে পারেনা। কাজেই এটাই সঠিক। ছেলেবেলায় শিক্ষকদের প্রতি আমার এমনই শ্রদ্ধাবোধ এবং বিশ্বাস ছিল, আস্থা ছিল। ওই আদর্শের জায়গাটি এমনই সংহত ছিল যে, শিক্ষকের শিখানোর বাইরে পিতামাতার ভিন্নমতের সঙ্গেও একমত হতে কষ্ট হতো । আরো ভাবতাম শিক্ষকগণ মিথ্যা বলেন না। তাঁরা কোনো অন্যায় কাজ করেন না।তখন তাঁদের চলন, বলন, পোশাক-আশাক, এমন কি চুলের স্টাইল পর্যন্ত অনুসরণীয় মনে করতাম।সবকিছু না পারলেও তাঁদের কিছু কিছু বিষয় তো অবশ্যই অনুসরন করতাম।
আমার শিক্ষকদের শিক্ষায় এবং নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে আদর্শের জায়গাটা আরো প্রসারিত করে নিয়েছিলাম।বুঝে বা না বুঝে সন্ধান করেছি হাতের কাছে ছিল যত পথ ও পন্থা।কোনটি ভালো ? কোনটি অধিক ভালো? কিংবা কোনটি আমার জন্য সুবিধাজনক বা পছন্দসই - এসব মিলিয়ে নিয়ে আদর্শ বা পথ নির্বাচন করেছি।
একটু বুদ্ধি হবার পর মা বলেছিলেন,’যুদ্ধ করো, জীবন গড়ো’।এই যুদ্ধ শত্রু নিধনের যুদ্ধ নয়।জীবন গড়ার জন্য শ্রম দেয়ার কথা বলেছিলেন মা।বলতেন,’কষ্ট করিলে কিষ্ট পাইবে’।এখানে ”কিষ্ট” মানে সুফল।এই ‘কিষ্ট’ প্রাপ্তির জন্য জীবনে একটা ‘লক্ষ্য’ থাকতে হয়।লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে আদর্শিক পথ দিয়ে অগ্রসর হতে হয়।আমার শিক্ষকদের শিখানো মতে এবং আমার পছন্দের আদর্শের জায়গায় আমি তখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে বসিয়েছি ।তারপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।আমার দেশপ্রেমের চেতনার ও মুগ্ধতার অন্যতম বিষয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ।আমি অভিভূত হয়েছি স্বামী বিবেকানন্দের চিকাগো ভাষণ পড়ে পড়ে।তারপর আমার আদর্শের ঘর আরো বড় হতে থাকে।আরো পড়তে পড়তে আমি পৌঁছে যাই আরো অনেক মহান ব্যক্তির ইশারার কাছে।সেখানে সহজেই চলে আসেন মহাত্মা গান্ধী,নেতাজি সুবাস বসু,শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,চিত্তরঞ্জন দাস, ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্যসেন,প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ,রাজা রামমোহন রায়, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত,কবি জীবনানন্দ দাস, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য , কবি জসিমউদ্দিন , মাদার তেরেসা,রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব,দাতা হরিশ্চন্দ্র, দানবীর হাজী মোহাম্মদ মহসীন,বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী এবং এমন আরো অনেক মহান মনিষিগণ - যাঁদের সকলের নাম এখানে উল্লেখ করতে গেলে তালিকা সুদীর্ঘ হয়ে যাবে।
তবে আমার শিক্ষায় আমি বিশ্ব-বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস এবং বিশ্ব-বিজয়ী আলেকজাণ্ডারের দুটি বিষয় অন্যতম ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে জীবনভর স্মরণে রেখেছি ।এই যেমন - সক্রেটিস বাজারে গিয়ে যখন বিক্রীর জন্য পশরা সাজানো পণ্য দেখতেন - তখন তিনি বলতেন, “What are the things I can do without?” সুতরাং মিতব্যয়ী হবার জন্য এই উক্তি থেকে শিক্ষণীয় আছে অনেক।
আর আলেকজাণ্ডার বলেছিলেন,“I am indebted to my father for living, but to my teacher for living well. {His teacher was the legendary philosopher Aristotle}” কাজেই তিনি একজন বিশ্ববিজয়ী হয়েও তাঁর পিতামাতার কাছে এবং শিক্ষকের কাছে “জীবন ও শিক্ষার” জন্য ঋণ স্বীকার করেছেন।এই মহান ব্যাক্তি মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর তিনটি শেষ অভিপ্রায়ও ছিল অত্যন্ত অর্থবহ।
প্রথমতঃ তাঁর কফিন বহন করতে হবে - তাঁর চিকিৎসক যারা ছিলেন তাদেরকেই,অর্থাৎ জগত দেখবে চিকিৎসকও শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঠেকাতে পারেনা। দ্বিতীয়তঃ তাঁর হাত দুটি কফিনের বাইরে রাখতে হবে, অর্থাৎ জগত দেখবে তিনি খালিহাতে দুনিয়াতে এসেছিলেন - আবার খালিহাতেই তিনি বিদায় নিচ্ছেন।আর তৃতীয়তঃ কবরের দিকে কফিন বয়ে নিয়ে যাবার সময় তাঁর অর্জিত টাকাকড়ি পথে ছিটাতে ছিটাতে যেতে হবে, অর্থাৎ মৃত্যুর পর তাঁর অর্জিত সব ধন-সম্পদের ওপর তাঁর আর কোনো অধিকার বা স্বত্ব-স্বার্থ নেই।তাই ত্যাগই মহত্তম।
আজকের এই প্রসঙ্গের অবতারণা এই জন্যে যে, আমাদের এখনকার শিশুরা কোন্ আদর্শ নিয়ে বেড়ে ওঠছে? তাদের কি আমরা লোভী - স্বার্থবাদী বা হিংসাবাদী হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছি ? নাকি উদারনৈতিক মানবতাবাদী দেশপ্রেমিক মানুষ বানাবো ? এই প্রশ্নটি মাথায় এসেছে বলেই এই আলোচনাটুকু প্রাসঙ্গিক ।
সুতরাং উল্লেখিত মনিষিদের মধ্য হতে তাঁদের কিছু আদর্শের বিষয় যদি আমাদের শিশু-কিশোরদের সামনে তুলে ধরা যায় , তবে তারা সহজে ‘ মানুষ’ হওয়ার এবং ‘বাঙালি’ হওয়ার জন্যে পথের নিশানা পেয়ে যেতে পারে বলে আমার একান্ত বিশ্বাস। কাজেই এই শিশুদের পথ দেখানোর দায়িত্ব আমাদের কাউকে না কাউকে তো নিতেই হবে।আদর্শের বিষয় ও সুফল লাভের পন্থা তাদের কাছে সহজে উপস্থাপন করে ‘মানুষ’ হওয়ার জন্য এবং ‘খাঁটি বাঙালি’ হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে ॥