সাধারণ মানুষের বীমা ভীতি ও প্রতিকার

 প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৩, ০৫:৪৫ অপরাহ্ন   |   মতামত

সাধারণ মানুষের বীমা ভীতি ও প্রতিকার

শেখ রিফাদ মাহমুদ :


বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক প্রকার বীমা ভীতি রয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষের কাছে কাছে বীমা মানেই প্রতারণা। অনেকে বীমা প্রতিষ্ঠান গুলোকে সমবায় সমিতির মতো মনে করে। পত্র-পত্রিকায় আমরা নিয়মিতই দেখতে পাই জনগণের সঞ্চিত অর্থ আত্মসাৎ করে তথাকথিত ভুঁইফোঁড় সমিতিরগুলো উধাও হওয়ার খবর। সাধারন মানুষের কাছে বীমাও যেনো সমিতির মতোই প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে বীমার সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা এবং বোঝার অভাব রয়েছে। অনেকে বুঝতে পারে না যে, বীমা কীভাবে কাজ করে বা কীভাবে এটি তাদের আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এসব কারণে অধিকাংশ মানুষ বীমা করতে দ্বিধাবোধ করে।



জনগণের বীমা কোম্পানির প্রতি আস্থার অভাবের কারণে তারা বীমা করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়। দেশে বীমা জালিয়াতি এবং অব্যবস্থাপনার ঘটনা ঘটেছে, যা জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে। বেশিরভাগ জালিয়াতি গুলো হয়েছে মূলক বীমা কর্মীদের দ্বারা। গ্রাহকের প্রিমিয়ামের টাকা কর্মীরা সংগ্রহ করে কোম্পানিতে জমা না দিয়ে অনেক সময় নিজেরাই আত্মসাৎ করেছে। যার ফলে গ্রাহক হয়েছে প্রতারিত, দোষ হয়েছে বীমা কোম্পানির। বর্তমান সময় বীমা শিল্প ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আসায় এসব দূর্নীতি হ্রাস পেয়েছে। গ্রাহক নিজেরাই নিজেদের প্রিমিয়ামের অর্থ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করতে পারছে।



বাংলাদেশের মানুষের বীমা ভীতির অন্যতম কারণ হচ্ছে বীমা চুক্তি না বোঝা। অনেকে মনে করে যেকোনো অর্থ জমা করলেই সেটি উত্তোলন করা যায়। তবে এক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে, শর্ত না বুঝে অর্থ দাবি করলে সেটি গৃহীত হয়না। যার ফলে বীমার দুর্নাম হয়। কেউ কেউ দুই-এক কিস্তি প্রিমিয়ার জমার পরে আর বীমা চালান না। যার ফলে বীমা তামাদী হয়ে যায়। যেটির অর্থ গ্রাহককে প্রদানের সুযোগ থাকেনা। যার ফলে গ্রাহকরা বীমা কর্মীদের বাড়িয়ে গিয়ে রূঢ় আচরণ করে থাকেন। বীমা কর্মীরা বিভিন্ন জায়গায় লাঞ্চনার শিকার হন। যেটি সারা বাংলাদেশের চিত্র।  যার প্রধাণ কারণ হচ্ছে বীমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, শর্ত না বোঝা এবং বিরূপ ধারণা।



একটা সময় ছিলো, যখন সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পেতো। ব্যাংকের পরিবর্তে আবাসস্থলের বিভিন্ন স্থানে গোপন জায়গা করে অর্থ সঞ্চিত করা হতো। মানুষের মনে এক প্রকার ধারণা ছিলো ব্যাংক মানেই যেনো প্রতারণা। ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় করলে হয়তো ব্যাংক সবকিছু নিয়ে পালাবে ঠিক এমনটাই ধারণা ছিলো সাধারণ মানুষের মনে। পরে যখন দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলো, ব্যাংক কর্মকর্তারাও সাধারণ মানুষের দৌঁড়গোড়ায় গিয়ে ব্যাংকের সুবিধা সম্পর্কে বোঝাতে থাকলো। তখন মানুষ বেশ আগ্রহের সাথে ব্যাংক মুখী হয়েছে। আর বর্তমানে সময় ব্যাংক ছাড়া তো আর্থিক লেনদেনের কল্পনাও করা যায়না। যদিও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যাংকেলর পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অর্থ আত্মসাৎ কেলেঙ্কারির সংবাদও দেখা যায়। তবুও ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা বিন্দুমাত্র কমেনি।



বীমা বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত হয়। বীমাকে ঘিরে সবচেয়ে সাধারণ বিতর্কগুলির মধ্যে একটি হল খরচ। কিছু লোক মনে করে যে বীমা প্রিমিয়ামগুলি খুব বেশি। বয়স, স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং ভৌগলিক অবস্থানের মতো কারণগুলির উপর নির্ভর করে বীমার খরচ ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, যা কিছু লোক বৈষম্যমূলক হিসাবে দেখে। বিতর্কের আরেকটি বিষয় হল দাবি অস্বীকার। বীমা কোম্পানিগুলি বিভিন্ন কারণে দাবি অস্বীকার করতে পারে, যার মধ্যে অপর্যাকাগজপত্র। এছাড়াও বীমা কোম্পানিগুলো গ্রাহণের অর্থ প্রদানে বিলম্বিত করাও বীমা বিতর্কিত হওয়ার অন্যতম কারণ।



বীমা হলো একজন ব্যক্তি (পলিসিধারী) এবং একটি বীমা কোম্পানির মধ্যে একটি চুক্তি, যেখানে বীমা কোম্পানি প্রিমিয়াম প্রদানের বিনিময়ে কিছু আর্থিক ক্ষতির জন্য পলিসিধারককে ক্ষতিপূরণ দিতে চুক্তিবদ্ধ হন। উন্নত দেশগুলোতে বীমার ব্যবহার বেশ ব্যাপক। ইউরোপে বীমা জাতীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, প্রতিটি দেশের বীমা কোম্পানি এবং নীতিমালার জন্য নিজস্ব নিয়ন্ত্রক কাঠামো রয়েছে। প্যান-ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে, যেমন ইউরোপীয় বীমা এবং পেশাগত পেনশন কর্তৃপক্ষ (EIOPA), যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন জুড়ে বীমা নিয়ন্ত্রণ এবং তত্ত্বাবধানে সমন্বয় করতে সহায়তা করে।



বীমার গ্রহণযোগ্যতা দেশ অনুসারে এবং বীমার প্রকারভেদে কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু দেশে, সরকার-প্রদত্ত স্বাস্থ্যসেবার জন্য পছন্দ থাকতে পারে, অন্যদের মধ্যে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বীমা। কিছু দেশে, জীবন বীমা এবং অবসরকালীন সঞ্চয় পণ্যের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়। ইউরোপ জুড়ে বীমা স্বীকৃত আর্থিক হাতিয়ার, যা ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলিকে আর্থিক ঝুঁকি পরিচালনা করতে এবং অপ্রত্যাশিত ক্ষতির বিরুদ্ধে রক্ষা করতে সহায়তা করে।



বীমা  বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক হাতিয়ার, যা ব্যক্তি এবং ব্যবসায়িকদের বিভিন্নভাবে সুরক্ষা প্রদান করে। বাংলাদেশে বীমা শিল্প বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (IDRA) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা ২০১০ সালে বীমা খাতের তত্ত্বাবধান ও তত্ত্বাবধানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আইডিআরএ বীমা কোম্পানির লাইসেন্স এবং নিয়ন্ত্রণ, বীমা পণ্য এবং পরিষেবাগুলির জন্য নির্দেশিকা নির্ধারণ এবং নিয়ন্ত্রক প্রয়োজনীয়তার সাথে সম্মতি নিশ্চিত করার জন্য দায়ী।



বাংলাদেশের বীমা বাজারে জীবন বীমা কর্পোরেশন, মেট লাইফ, গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্স, গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং প্রগতি ইন্স্যুরেন্স সহ কয়েকটি বড় কোম্পানির আধিপত্য রয়েছে। বেশ কিছু ছোট কোম্পানিও কাজ করছে।



বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরণের বীমা চলমান রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: স্বাস্থ্য বীমা, জীবন বীমা, ইসলামী শরিয়াহ বীমা, গাড়ি বীমা, ব্যবসায়িক বীমা সহ বিভিন্ন ধরণের বীমা রয়েছে। প্রতিটি বীমা ঝুঁকির বিষয়ে কভারেজ প্রদান করে। বীমার উদ্দেশ্য হলো অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা পরিস্থিতির কারণে ঘটা আর্থিক ক্ষতি থেকে ব্যক্তি এবং সত্তাকে রক্ষা করা। উদাহরণস্বরূপ, গাড়ি বীমা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে গাড়ির ক্ষতির জন্য কভারেজ প্রদান করতে পারে, স্বাস্থ্য বীমা চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য কভারেজ প্রদান করতে পারে।



ব্যক্তি এবং ব্যবসা উভয়ের জন্যই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য বীমা অন্যতম হাতিয়ার। ক্ষতির কিছু ঝুঁকি একটি বীমা কোম্পানিতে স্থানান্তর করার মাধ্যমে, ব্যক্তি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে তাদের সম্পদ রক্ষা করতে পারে। বীমা কভারেজ এক প্রকার মানসিক শান্তি প্রদান করতে পারে। কারণ এটি আর্থিক ক্ষতি সম্পর্কে চাপ এবং উদ্বেগ কমাতে পারে। যা ব্যক্তি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গুলোকে তাদের কার্যক্রমে জোড় দিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।



সামগ্রিকভাবে, বীমা আর্থিক ঝুঁকি কমাতে এবং ব্যক্তি ও সংস্থাকে অপ্রত্যাশিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর্থিক সুরক্ষা প্রদান এবং দায়িত্বশীল আচরণের প্রচারের মাধ্যমে, বীমা আরও স্থিতিশীল এবং নিরাপদ আর্থিক ভবিষ্যতের জন্য অবদান রাখতে পারে।



কভারেজের পরিমাণ এবং বীমা প্রিমিয়ামের খরচ, বীমার ধরন এবং যে ব্যক্তি বীমা করছে তার চাহিদার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। বীমা পলিসি নির্দিষ্ট চাহিদা এবং ঝুঁকি পূরণে সংযোজন-বিয়জন করা যেতে পারে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক ক্ষতির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য বীমা একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এতে সন্দেহ নাই



বাংলাদেশের মানুষের বীমা বিমুখ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বীমা বিষয়ে  ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে চলমান বিতর্ক। ইসলামিক স্কলারদের বীমা বিষয়ে কোন একক এবং সর্বজনস্বীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি নেই। ইসলামিক অর্থনীতিতে কিছু সাধারণ নীতি রয়েছে যা বীমা সংক্রান্ত আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিক। ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হলো রিবা বা সুদের নিষেধাজ্ঞা, যা ঋণের উপর সুদ আদায় বা পরিশোধকে বোঝায়। কিছু ইসলামী স্কলাররা যুক্তি দেন যে প্রচলিত বীমাতে রিবা জড়িত, কারণ পলিসি হোল্ডাররা প্রিমিয়াম প্রদান করে যা বীমা কোম্পানির দ্বারা বিনিয়োগ করা হয়, একটি রিটার্ন লাভের প্রত্যাশায়। তারা বিশ্বাস করেন যে এটি একটি সুদ-ভিত্তিক লেনদেন গঠন করে, যা ইসলামী অর্থে নিষিদ্ধ।



আবার অন্যদিকে কিছু ইসলামিক স্কলাররা বীমা সম্পর্কে অনুমোদনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেন, যুক্তি দেন যে এটি পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ঝুঁকি ভাগাভাগির একটি রূপ যা ইসলামী আইনের অধীনে অনুমোদিত। তারা এই বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে যে বীমা অপ্রত্যাশিত ক্ষতির বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য সংস্থানগুলিকে একত্রিত করে এবং পলিসিধারীরা বীমা পুলের ঝুঁকি এবং সুবিধার অংশীদার হন।



তবে এসব বিতর্কের জবাবে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তাকাফুল নামে পরিচিত বেশ কয়েকটি ইসলামী বীমা তৈরি হয়েছে। তাকাফুল হল এক ধরনের সমবায় বীমা, যা ইসলামী নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গঠন করা হয়েছে। পলিসিহোল্ডাররা অর্থ জমা রাখে যা ক্ষতি পূরণ করতে ব্যবহৃত হয়। সামগ্রিকভাবে, ইসলামী অর্থব্যবস্থায় বীমার অনুমোদনের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ঐকমত্য না থাকলেও, ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী বিমা রয়েছে। যা শরিয়াহ সম্মত।



সামগ্রিকভাবে, বীমা আর্থিক ঝুঁকি পরিচালনা এবং অপ্রত্যাশিত ক্ষতির বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট প্রিমিয়াম প্রদান করে, আর্থিক সুরক্ষা এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা ক্ষতির ক্ষেত্রে সুরক্ষিত থাকা যায়।



সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সরকার শিল্পের নিয়ন্ত্রণ এবং তত্ত্বাবধানকে শক্তিশালী করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ভোক্তারা যাতে সুরক্ষিত থাকে এবং শিল্পটি যেনো সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য। বর্তমানে ১লা মার্চ বীমা দিবস জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বীমা গ্রহণ ও গ্রহণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ থাকলেও, এই শিল্পে প্রবৃদ্ধি ও বিকাশের সম্ভাবনাও রয়েছে। বিশেষ করে শরিয়াহ-সম্মত বীমা গুলোর ক্রমবর্ধমান গতিশীল হওয়া অন্যতম কারণ। জনগণের কাছে বীমার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভালোভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে আরোও আস্থা অর্জন করা সম্ভব। বীমা শিল্পে সরকারের আরোও জোড়ালো নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান; বীমা শিল্পকে আরোও এগিয়ে নিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার মনে হয়।




(শেখ রিফাদ মাহমুদ,  চেয়ারম্যান, এসআরআই ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন)