সাংবিধানিক স্থানীয় সরকার কমিশন

 প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:৩২ অপরাহ্ন   |   মতামত

সাংবিধানিক স্থানীয় সরকার কমিশন

মুঃ আবদুল হাকিম : 

দল থাকলে দলীয়তা এবং দলাদলি স্বাভাবিক । কিছুদিন আগেও দলের সাধারণ সম্পাদক থাকতেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী যার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতো।এর ফলে সর্বত্র দলের সর্বময় কর্তৃত্ব কায়েম হয়। ফলশ্রুতি স্বরূপ দলের বাইরে স্বাধীনচেতা জননেতা তৈরী হওয়ার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।আমাদের সংবিধানে দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলা আছে স্থানীয় প্রশাসন চলবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে।আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা আছে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বিগত ৫০ বছরে দেশে উল্লেখযোগ্য কোন স্থানীয় সরকার অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। বর্তমান জেলা পরিষদ এবং উপজেলা পরিষদ আইনেও স্থানীয় সরকারগুলো শক্তিশালী হয়নি।সরাসরি ভোটে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার বিধান রাখা হয়নি। বরং ব্রিটিশ আমলের জেলা বোর্ডের কার্যকারিতাকে খর্ব করা হয়েছে। সাংসদগণ নির্বাহী কর্মকাণ্ডে ক্রমশ অতিউৎসাহী হয়ে উঠছেন। স্থানীয় সরকার অবকাঠামো মজবুত না থাকার কারণে তারা এইসব জায়গায় নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছেন। শক্তিশালী স্থানীয় সরকার হলে তাদের এই নির্বাহী ক্ষমতা লোপ পাবে। এই কারণে তারা স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালীকরতেঅনীহাপ্রকাশ করছেনঅথবা নিলিপ্ত ভূমিকা পালন করছেন।


তাছাড়া আরেকটি কারণে এই দেশে স্থানীয় সরকার অবকাঠামো শক্তিশালী হয়নি। কারণটি হল স্থানীয় সরকার কার্যকর হলে কেন্দ্রের অতিমাত্রায় ক্ষমতায়ন  ব্যাহত হবে। অথচ কেন্দ্রের অতিমাত্রায় ক্ষমতায়ন জনস্বার্থ বান্ধব নয়। এতে জনগণের উন্নয়ন ও প্রশাসনে অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। সংবিধানের ৩য় পরিচ্ছেদ স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত। অনুচ্ছেদ ৫৯(১) আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠান সমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক ইউনিটের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হবে। (২) এইসংবিধান ও অন্য কোনো আইনসাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করবে, এইঅনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লিখিত প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক ইউনিটেরমধ্যে সেরূপ দায়িত্ব পালন করবে এবং অনুরূপ আইনে নিম্নলিখিত বিষয় সংক্রান্ত দায়িত্ব সমূহ অন্তর্ভূক্ত হতে পারবে ;

(ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারিদের কাজ,

(খ) জনশৃঙ্খলারক্ষা,

(গ) জনসাধারণের কাজ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন।

অনুচ্ছেদ ৬০   এই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের বিধানাবলীকে পূর্ণ কার্যকারিতাদানের উদ্দেশ্যে সংসদ আইনের দ্বারা উক্ত অনুচ্ছেদে উল্লিখিত স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমুহকে স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করবার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ এবং নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা প্রদান করবে।এটা না হওয়াটা সংবিধান অবমাননার সামিল। আমাদের দেশে সংবিধান অবমাননার আইন না থাকায় কাওকে দায়বদ্ধ করা যাচ্ছে না। স্বাধীনচেতা, সৎ, যোগ্য,ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ,নিরপেক্ষ এবং নির্দলীয় জননেতা তৈরী করার একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে স্থানীয় সরকার কমিশন। অনেক স্বাধীনচেতা, সৎ এবং যোগ্য জননেতা টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনতে অনীহা প্রকাশ করেন।এমপিদের দলীয় মনোনয়ন দরকার হতে পারে।যদিও সংবিধানের সত্তর অনুচ্ছেদের জন্য স্বতন্ত্র এমপিদের সংখ্যা এখন প্রায় শূন্যের ঘরে। স্থানীয় সরকার দলীয় মনোনয়নে হলে উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন এবং বিভাগীয় প্রশাসনের কোনো সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। এজন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।কেননা কেবল মাত্র নির্দলীয় রাজনীতিই বাফার স্টেট হিসেবে বিভিন্ন দলীয় রাজনীতির মধ্যে সমঝোতা এবং সহমর্মিতার পরিবেশ রচনা করতে পারবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে জংগিবাদ এবং ফ্যাসিবাদকে উদার নৈতিকতা দিয়ে মোকাবিলা করতে পারবে। স্থানীয় সরকারকে ব্যবহার করে একদল আরেক দলকে দমন পীড়ন এবং নির্মূল করতে পারবে না। অথবা অন্য কোনো ধর ণের বাড়াবাড়ি করার আর কোনো অবকাশ পাবে না। প্রচন্ড ঘৃণা বিদ্বেষ এবং এক দলের প্রতি আরেক দলের চরম অবিশ্বাস ধীরে ধীরে প্রশমিত হবে।সাংবিধানিক সংস্থাসমূহ এবং স্থানীয় সর কারগুলোর যৌথ কর্মতৎপরতায় ভয়ের সংস্কৃতির পরিবর্তে দেশে আইনের শাসনের পরিবেশ ফিরে আসবে।


গ্রাম প্রশাসন, ইউনিয়ন প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন , জেলা প্রশাসন এবং বিভাগীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকারগুলোর সাথে একীভূত হয়ে যাবে। জাতীয় সরকার স্থানীয় সরকার সমূহের কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না থেকে শুধুমাত্র সংসদ আইনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।স্থানীয় সরকারের জন্য কোনো আলাদা মন্ত্রণালয় থাকার প্রয়োজন নেই।স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় স্থানীয় সরকার কমিশন দেখতে পারে। স্থানীয় সরকার নিজ স্বক্ষমতা বলে কিছু রাজস্ব সংগ্রহ করবে। সরকার কিছু থোক বরাদ্দ দিতে পারে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দলীয় মনোনয়নে করা সমীচীন নয় । স্থানীয় সরকার হবে একটি নির্দলীয় প্রতিষ্ঠান । পাঁচটি স্তরে স্থানীয় সরকার কাজ করতে পারে। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে। স্থানীয় সরকারগুলো হবে নির্বাচিত এবং তাদের কোনো নিয়োগ বা পদোন্নতি প্রদানের ক্ষমতা থাকবে না। এ ক্ষমতা দিলে স্থানীয় সরকার নিজেদেরগুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ দিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যে লিপ্ত হবে। ক্যাডার কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সকল কর্মচারী গণ এখানে প্রেষণে কাজ করবে।


স্থানীয় পর্যায়ে কোনো দ্বৈত সরকার কাজ করবেনা। পুলিশ, প্রকৌশলীগণ এবং প্রশাসন প্রেষণে স্থানীয় সরকারের অধীনে কাজ করবে। স্থানীয় সরকারের উপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্তৃত্ব কাজ করবে না। জাতীয় সরকার প্রয়োজন অনুসারে তাদের মাঠ পর্যায়ে নিয়োগ করবে। স্থানীয় সরকার কমিশন হবে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কমিশন স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত একটি বার্ষিক প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করবে। রাষ্ট্রপতি সেটি আলোচনার জন্য পার্লামেণ্টে প্রেরণ করবে। এভাবে স্থানীয় সরকার কমিশন পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহিতা করবে। স্থানীয় সরকার জাতীয় সরকারের হাতে না থাকলে রাষ্ট্রে  ক্ষমতার একটা ভারসাম্য ফিরে আসতে পারে।স্থানীয় সরকারগুলো অনেকটা স্বাধীনভাবে জনকল্যাণ মূলক কাজ করতে পারবে। অফিসগুলো জনবান্ধব হবে। গণহয়রানি কমবে। পুলিশও গণমুখী এবং দায়িত্বশীল হবে। কমিশন পার্লামেণ্টের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।এমপিরা তাদের কাজ কর্মের সমালোচনা করতে পারবে।সাংবিধানিক কমিশনগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন সমূহ পার্লামেণ্টে আলোচনা হবে। পার্লামেন্টারি জবাবদিহিতা থাকলে ক্ষমতা নিয়ে কমিশনগুলো বাড়াবাড়ি করার  আর অবকাশ পাবে না। কেন্দ্রীয় সরকার অথবা স্থানীয় সরকারের কেউ সরকারি কর্মচারিদের নিয়োগ বা পদোন্নতির সাথে যুক্ত থাকবে না। এগুলোর নিয়োগ বা পদোন্নতি দেখবে সংশ্লিষ্ট পাবলিক সার্ভিস  কমিশন। সরকারের হাতে নিয়োগ এবং পদোন্নতি না থাকলে  সরকারি কর্মচারিগণ স্বাধীনতা এবং নৈতিকতা নিয়ে কাজ করতে পারবে।মেরুদণ্ড নিয়ে কাজ করতে পারবে। অন্যথায় তা পারবে না।


স্থানীয় সরকার তাদের নিজস্ব সম্পদ আহরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে থোক বরাদ্দ আদায় করবে। দ্বৈত সরকার থাকবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সমন্বয় করে স্থানীয়  সরকারগুলো কাজ করবে।  মাঠ প্রশাসন দেখবে স্থানীয় সরকার। কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করবে। ব্যাপক আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে পুরোনো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করা যেতে পারে যাতে ছোটখাটো কোনো অসংগতিও না থাকে। সংসদ এবং সর্বস্তরের জনগণের মতামত নিয়ে নতুন সংবিধান চূড়ান্ত করা যেতে পারে।স্থানীয় পর্যায়ে স্থানীয় সরকারই হবে চূড়ান্ত কতৃপক্ষ । উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় প্রশাসন নামে এখানে আলাদা কিছু থাকবেনা । এগুলো স্থানীয় সরকারে মার্জ হয়ে কাজ করবে। সংবিধানের আলোকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই এখানে জনগণের ভালমন্দ দেখবে।কোনো ব্যক্তি মাঠ প্রশাসনকে হাত করে নিজের ক্ষমতা এবং সুবিধা বাগিয়ে নিতে পারবে না। একদল আরেক দলের প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণ হওয়ার কোনো অবকাশ পাবে না। কঠোর সাংবিধানিক শৃংখলায় দেশ ক্রমশঃ এগিয়ে যাবে। জনগণকে ফাঁকি দিয়ে নয়- জনগণকে সাথে নিয়ে।


স্থানীয় সরকারগুলো হবে আইনানুগভাবে শক্তিশালী । ক্রিমিনালদের ব্যাপারে তাদের কঠোর এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা থাকবে। তারা নাগরিক আদালতের কাছেও সর্বদা দায়বদ্ধ থাকবে। জেলায় যে কোনো নাগরিক তাদের আইনানুগ কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। আদালত তাদের খোলামেলা সমালোচনা করবে এবং  আইনের বাউন্ডারির মধ্যে  রাখবে। একাডেমিয়া সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগগুলো নাগরিক স্বার্থে হচ্ছে কিনা তা নিবিড়ভাবে তদারক করবে এবং সমালোচনা করবে।