ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের সামরিক কূটনীতি

 প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৩৪ অপরাহ্ন   |   মতামত

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশের সামরিক কূটনীতি

কামাল উদ্দিন মজুমদার:

ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত কেন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করে, তাই ভারত মহাসাগর আজ সমস্ত ভূ-কৌশলগত রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বৈশ্বিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই অঞ্চলে সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রধান শক্তিগুলো এই অঞ্চলের দেশগুলির সাথে তাদের কৌশলগত সম্পৃক্ততা গভীর করেছে। ইন্দো প্যাসিফিক আর্মি ম্যানেজমেন্ট সেমিনার (আইপিএএমএস) একটি ইউএস আর্মি প্যাসিফিক (ইউএসএআরপিএসি) পরিচালিত কনফারেন্স যা ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের সেনাবাহিনীর মধ্যে  সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ও উন্নত করে। এই বছরের ৪৬তম ইন্দো প্যাসিফিক আর্মিস ম্যানেজমেন্ট সেমিনার (আইপিএএমএস) ২০২২ ঢাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী যৌথভাবে আয়োজন করেছে। এর উদ্দেশ্য হল পারস্পরিক বোঝাপড়া, সংলাপ এবং বন্ধুত্বের মাধ্যমে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এটি এই অঞ্চলের স্থল বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বড় সম্মেলন এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি প্রধান সংযোগ। এটি ইন্দো প্যাসিফিক আঞ্চলের স্থল বাহিনীর সিনিয়র সামরিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার বিষয়ে মতামত ও মতামত বিনিময় করার জন্য একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম প্রদান করে।


বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে প্রাচীন ইন্দো প্যাসিফিক সংযোগের অংশ। একটি বাধাহীন, উন্মুক্ত এবং আন্তঃসংযুক্ত ইন্দো প্যাসিফিকের অঞ্চলের সাথে বৃহত্তর অর্থে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ও সমৃদ্ধ জাতি রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান এই ধারণার উপর নির্ভর করে। প্রায় ৪০টি দেশ নিয়ে ইন্দো- প্যাসিফিক অঞ্চল গঠিত যা পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি জুড়ে বিশ্বের ৬০% জনসংখ্যা ও বিশ্বব্যাপী জিডিপির ৬০% অবদান রাখে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবেশকারী মধ্যবিত্তের ২.৪ বিলিয়ন নতুন সদস্যদের সিংহভাগ (৯০%) ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে বসবাস করবে। বিশ্বের ১০টি বৃহত্তম সেনাবাহিনীর মধ্যে সাতটি এই অঞ্চলে যেখানে সীমান্ত বিরোধ এবং সার্বভৌমত্বের উদ্বেগের ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত। তাই এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা বিশ্বব্যাপী অগ্রগতির কেন্দ্রবিন্দু।

এমন কিছু সমস্যা আছে যেগুলো শুধু একটি বা দুটি দেশের দ্বারা বিচ্ছিন্নভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। এই প্লাটফর্মটি এ অঞ্চলের সব দেশের সামরিক নেতাদের একত্র হয়ে তাদের চিন্তা-ধারণা ও কৌশলগুলো আলোচনা করে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎক্ষণিক সমস্যার সম্মিলিত সমাধান খুঁজে পেতে সাহায্য করে। আর্মি টু আর্মি সংযোগের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সম্পর্ক বাস্তবসম্মত বহু মাত্রিক সমস্যা সমাধানে পৌঁছানোর জন্য এবং ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবেলার জন্য সাধারণ স্বার্থের সমস্যাগুলি চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।


তাছাড়া কৌশলগত পর্যায়েও আস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাই ইন্দো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য সেনাবাহিনীকে সরকারী নীতি নির্ধারকদের সাথে একত্রে কাজ করতে হবে এবং একটি উন্নয়ন ভিত্তি তৈরি করতে হবে যা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে সংযুক্ত করে। আইপিএএমএস এই অঞ্চলের টেকসই অগ্রগতির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন পরিবর্তন এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমস্ত স্তরে সামরিক প্রধানদের মধ্যে নেটওয়ার্ককে প্রসারিত করবে। এই ফোরাম নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার জন্য একে অপরের ভূমিকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার সাথে সাথে মূল বিষয়গুলিকে বোঝার জন্য একটি অনন্য সুযোগ প্রদান করে। এটি ব্যক্তিককেন্দ্রিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে এই অঞ্চলের স্থল বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা তৈরি করবে যা উত্তেজনা  হ্রাস করে সাধারণ স্বার্থ এবং উদ্বেগের বিষয়গুলির আলোচনাকে ত্বরান্বিত করবে। ৪৬ তম সম্মেলন দেশগুলির স্থল বাহিনীর মধ্যে বর্ধিত সহযোগিতা, পারস্পরিক আস্থা ও শক্তিশালী বন্ধনের মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে টেকসই শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির বার্তা নিয়ে এসেছে। সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, "আইপিএএমএস বন্ধুত্ব ও উষ্ণতার অনুভূতি তৈরি করতে পারে যাতে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করে। ইউএস আর্মি প্যাসিফিকের কমান্ডিং জেনারেল চার্লস এ ফ্লিন আশ্বস্ত করেছেন যে এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং অন্যান্য ইন্দো প্যাসিফিক দেশগুলির সাথে সহযোগিতা করবে।


এই সম্মেলন বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতারও একটি প্রতীক। এটি দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে শক্তিশালী সহযোগিতার পথও প্রশস্ত করেছে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান বলেছেন “মার্কিন সেনাবাহিনী বিশ্বের অন্যতম সেরা এবং অত্যন্ত উন্নত। একসাথে কাজ করলে একে অপরের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার সুযোগ রয়েছে। এই সম্মেলন খুবই উৎসাহব্যঞ্জক এবং ইউএস বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।”

অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সামরিক বাহিনী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক অপরাধ, নিরাপত্তা সমস্যা এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আলোচনা করলেও মিয়ানমারে সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়নি। এটা অনস্বীকার্য যে যেহেতু রোহিঙ্গা সঙ্কট ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্রে শুরু হয়েছে তাই এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সরাসরি হুমকি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। জনাকীর্ণ শিবিরে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, চীন এবং ভিয়েতনাম সহ ২৪ টি দেশের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছে যেখানে রোহিঙ্গারা তাদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, তৃতীয় কোনো দেশে নয়। প্রতিনিধিবর্গ রোহিঙ্গাদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন।


বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তার ইতিবাচক ও সক্রিয় ভূমিকায় দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের সুদক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব মঞ্চে দেশকে গৌরবান্বিত করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম ক্রমাগতভাবে বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে তার শান্তিরক্ষীদের কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন করছে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। সৈন্য প্রেরণকারী হিসাবে দেরিতে প্রবেশকারী (১৯৮৮ সালে) হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ গত তিন দশকে জাতিসংঘের একটি বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশ ১,৮০০ টিরও বেশি মহিলা শান্তিরক্ষী সহ ১৭৫,০০০ এরও বেশি ইউনিফর্মধারী কর্মী ৫টি মহাদেশ জুড়ে ৪০টি দেশে ৫৪টি শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। বর্তমানে ১০টি মিশনে ৭,০০০ সৈন্য ও পুলিশ মোতায়েন রয়েছে (সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের তথ্য অনুযায়ী)। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে মার্কিন সেনা জেনারেল চার্লস এ ফ্লিন বলেন “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অবদানের কারণে বিশ্বব্যাপী তার নেতৃত্বের জন্য পরিচিত। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শুধুমাত্র এই অঞ্চলের মধ্যে পরিচিত নয় তারা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত।  বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষা কার্যক্রম, মানবিক সহায়তা, ত্রান কার্যক্রম ও বৈশ্বিক শান্তি স্থাপনে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী ও অন্যান্য অনেক দেশের সেনাবাহিনী শিখতে পারে’’। এই স্বীকৃতি আবারও প্রমাণ করেছে যে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী বিশ্ব শান্তি বজায় রাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং আমাদের দেশকে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুদের নাশকতামূলক কার্যকলাপ থেকে নিরাপদ রাখতে সক্ষম।


এই সম্মেলনটি জোটের অংশীদারিত্ব এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বিশ্বের সামরিক নেতাদের সাথে সংযোগ স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরী করেছে। আশা করা যায় যে এই ধরনের সংলাপ ইন্দো প্যাসিফিক দেশগুলি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে এবং এই অঞ্চলকে নিরাপদ ও টেকসই উপায়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পারস্পরিক সহযোগিতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে।


(কামাল উদ্দিন মজুমদার : গবেষক ও কলামিস্ট)