মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ সীমান্তে গোলাবর্ষণ বন্ধ করতে হবে
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন | মতামত

মেহজাবিন ভানু:
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দুই মাস ধরে যে সংঘাত তার প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতে। বিশেষ করে বান্দরবানের ঘুমধুম ও তমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে। অন্যদিকে এসব রাজ্যের বহু মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী থেকে গোলাবারুদ আসছে আমাদের সীমান্তে। আতঙ্কে রয়েছে সীমান্তের গ্রামবাসীরা।
গত ৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ভূখন্ডে গোলাবর্ষণের কারণে তাদের সতর্ক করতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে। সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় যে কোনো ধরনের গোলাবর্ষণের আগে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তথ্য আদান প্রদানের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো তথ্য বিনিময় হয়নি। এক সময় আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বোঝাপড়া থাকলেও এখন তারা বিভিন্ন জায়গায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে বলেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটা যেমন ঠিক জীবন বাঁচাতে ওপার থেকে রোহিঙ্গাদের আগমনও ঘটতে পারে। সেই সঙ্গে সেখানকার বিদ্রোহীরাও সীমান্ত পেরিয়ে ভেতরে আসতে পারে। অবশ্যই সেখানে টহল দেওয়া বেশ কঠিন। এ অবস্থায় আমাদের বিজিবিসহ অন্য সব নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে।
কিন্তু মিয়ানমারের কী হলো? এটা এখন সবার প্রশ্ন। তবে সামরিক শাসনে মিয়ানমারের কঠোর সেন্সরশিপের কারণে সে দেশ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া খুবই কঠিন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি, বান্দরবানের বাসিন্দা ও মিয়ানমারের সংবাদপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আগস্টের শুরু থেকে রাখাইন, তানপট্টি ও হাকা রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান বিদ্রোহী বাহিনীর লড়াই চলছে।
সামরিক জান্তা ২০২৩ সালের আগস্টে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন করতে চায়। এর আগে তারা তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী গত মে মাস থেকে কায়া, কাইন ও চিন রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করেছে। সে দেশের সামরিক বাহিনীও এই যুদ্ধে হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে। থাইল্যান্ড ভিত্তিক মায়ানমারের দৈনিক ইরাওয়াদির মতে ৪ সেপ্টেম্বর মংডুতে আরাকান আর্মির হামলায় কমপক্ষে ১৯ জন বর্ডার গার্ড পুলিশ নিহত হয়। তারা স্টেশনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। এরপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার দিয়ে বিমান হামলা চালায়। রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে এসব বিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়। গত আগস্ট থেকে আরাকান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে। এক মাস ধরে প্রতিদিনই সীমান্তের ওপার থেকে গুলির শব্দ আসছে।
বেশ কয়েকদিন ধরে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করতে দেখা গেছে। সাংবাদিকরা বাসিন্দাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছেন যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আরাকান বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে। সেনাবাহিনী একের পর এক গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে। বহু গ্রামে বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউএস ইনস্টিটিউট অফ পিস অনুসারে আরাকান আর্মির সাথে ২০২০ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তির আগে মিয়ানমারে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাখাইন রাজ্যেও সামরিক বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পায়। এই উপলক্ষ্যে আরাকান আর্মি যুদ্ধবিরতি থেকে বেরিয়ে এসে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। সামরিক জান্তা ২০২৩ সালের আগস্টে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন করতে চায়। তার আগে তারা রাখাইন এবং অন্যান্য রাজ্যে তাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইন্সটিটিউট অফ পিস বলছে রাখাইন রাজ্য তাদের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী।
ডেইলি ইরাওয়াদির মতে ২ এ আগস্ট আরাকান আর্মি বেশ কয়েকটি জায়গায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর আক্রমণ শুরু করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করেছে। ইরাবদি বলেন,হেলিকপ্টার এবং বিমান হামলার পাশাপাশি সেখানে ছয়টি সেনা পোস্ট থেকে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ শেল নিক্ষেপ করা হয়। অন্যদিকে জান্তা বিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) সাগাইং এবং মাগওয়া অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সাথে প্রচন্ড লড়াই শুরু করেছে।
চীনা রাজ্যের অন্তত দুটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী চীন প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং চাইনিজ ন্যাশনাল আর্মি বহু দিন ধরে দেশটির সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে় যাচ্ছে। ইরাবদি নিউজ পোর্টাল অনুসারে কারেনি ন্যাশনালিটিস ডিফেন্স ফোর্স এবং কারেনি আর্মি সহ বেশ কয়েকটি বিদ্রোহী দল গত মে থেকে কায়াহ রাজ্যে সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করছে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে যে তারা এখন পর্যন্ত ১৫০০ সৈন্যকে হত্যা করেছে যদিও এই তথ্যটি বস্তুনিষ্ঠভাবে যাচাই করা যায়নি।
গত বছর থেকে সে দেশে গণতন্ত্রপন্থী কর্মীরাও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিয়মিত বিক্ষোভ, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। একই সঙ্গে বাড়ছে সেনাবাহিনীর দমন পীড়ন ও নির্যাতন। ভারী গোলাগুলি, মর্টার, বিমান এবং ভারী কামানের গোলাগুলি ছাড়াও মিয়ানমার সেনাবাহিনী এই বিদ্রোহীদের ব্যবহার করছে। তারা সেখানে বেশ কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং গ্রামে গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে। ফলে এসব এলাকা থেকে বহু মানুষ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি এলাকা ভারতের মিজোরামে যাচ্ছে। যেখানে সংঘাত চলছে তাও শুধু সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে। ফলে সেখানে সংঘর্ষে আতঙ্কিত সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশিরা। গত ২৮ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির তমব্রু উত্তর পাড়ার কাছে এসে পড়ে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।
তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বাসিন্দারা বলেছেন যে সেপ্টেম্বরে সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার থেকে গুলি বাংলাদেশ সীমান্তের ১৫০ মিটারের মধ্যে পড়েছিল।
গড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা কয়েক বছর ধরে নাইক্ষ্যছড়ির তমব্রু সীমান্ত লাইনে বসবাস করে আসছে যেখানে এই সহিংসতা চলছে। সহিংসতার কারণে তারা বাংলাদেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সংঘাত সীমান্তের ওপারে হলেও বাংলাদেশের তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ যেখানে সংঘাত হচ্ছে বলা হচ্ছে সেখানে আন্দোলন বেশ কঠিন। এ ধরনের গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকলে তা বাংলাদেশের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে এমন এলাকায় যেখানে প্রবেশ বা চলাচল কঠিন।