মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উস্কানি এবং করনীয়

 প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০২:৪২ অপরাহ্ন   |   মতামত

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার উস্কানি এবং করনীয়

মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ :

মিয়ানমার এক অভিসপ্ত এবং নির্মম অত্যাচারী  সেনাশাসিত রাষ্ট্র। বৌদ্ধ সম্প্রদায় জীব হত্যাকে মহাপাপ মনে করলেও বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মায়ানমার ভয়ানক অমানবিক একটি জাতির উদাহরন হিসেবে চিহ্নিত। মায়ানমারের সামরিক জান্তার মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিটলারের নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে।একটি জাতিসত্তাকে নির্মূল শুধু ধর্মীয় কারনে হতে পারে যা একবিংশ শতাব্দীর এক নির্মম কর্মযজ্ঞ।চীনের  ছত্রছায়ায় সামরিক জান্তা শুধুমাত্র রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তাকে বিলীন করেনি দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতা দখল, রাজনৈতিক নিপীড়ন, হত্যা,হামলা-মামলায় বিশেষ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।


সামরিক জান্তা শুধুমাত্র নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে দেশের জনগনের চাইতে বন্দুকের নল বেশী শানিত করে।মজুদ করে সামরিক সরঞ্জাম।মায়ানমার বিশ্বের ৩৮তম সামরিক সমৃদ্ধ দেশ। সৈন্য সংখ্যা সর্বমোট ৫ লাখ ১৫ হাজার। তন্মেধ্যে সামরিক ৪ লাখ ৫ হাজার,বেসামরিক ১ লাখ ১০ হাজার।


অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের ৪৫ তম সামরিক সমৃদ্ধ দেশ, সৈনিক ১ লক্ষ ৬০ হাজার।বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন মিয়ানমার হতে বহুগুন বেশী।


বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত অঞ্চল তমব্রু এলাকায় মায়ানমার সেনাবাহিনীর মটরসেল বিস্ফোরনে একজন বাংলাদেশীর পায়ে আঘাত পেয়েছে,বাড়িয়েছে সামরিক তৎপরতা। সীমান্তে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক তৎপরতাকে দেখে যে কারোরই মনে হতে পারে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের ‘যুদ্ধ’ সময়ের ব্যাপার মাত্র।  অনেকেই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সামরিক সক্ষমতার তুলনাসহ নানা ধরনের সূচকও প্রকাশ করছেন। সাধারণত দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে এ ধরনের আলোচনা সামনে আসে। অবশ্য দুই দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা বা তাদের কী পরিমাণ সাজোয়া যান, অস্ত্র ইত্যাদি আছে তার পরিসংখ্যানের ওপর যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ভর করে না। চলমান ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ তার প্রমাণ। বিশাল সামরিক শক্তির অধিকারী রাশিয়াকে ইউক্রেনের যোদ্ধারা নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে। ইউক্রেনীয় সেনাদের চেয়ে রাশিয়ার সেনাদের উন্নত প্রশিক্ষণ অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ার সেনাদের লড়তে নাকের জল চোখের জল এক হয়ে যাচ্ছে।


বাংলাদেশের ভেতরে মিয়ানমারের গোলা ও গুলি ছোড়ার ঘটনা কোনও কোনও গণমাধ্যমে উসকানি বলে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে সবদিক বিবেচনা করে মিয়ানমার কর্তৃক উপর্যুক্ত ঘটনাগুলো দুর্ঘটনাক্রমে ঘটেছে বলে মনে হয়েছে। কারণ এই বিষয়টি পরিষ্কার যে মিয়ানমার সৈনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির সঙ্গে যে যুদ্ধে লড়ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে ওই গুলি ও গোলা ছোঁড়া হয়েছে। শান্তিকালীন সময়ে ওই ধরনের ঘটনা ঘটলে তা উসকানি হিসেবে বিবেচনা করা যেত। আর মিয়ানমার অভ্যন্তরীণ সংকটে এতটা জর্জরিত যে তাদের পক্ষে বাংলাদেশকে উসকানি দিয়ে যুদ্ধে নামানোর মতো পরিস্থিতিতে তারা এই মূহূর্তে নেই।


বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তৎপরতাও বেশ দুর্বল। কারণ ওই এলাকাগুলো খুবই দুর্গম এবং তা মূলত আরাকান আর্মিসহ বিছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর অলিখিত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বর্তমানে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ওই এলাকায় তাদের প্রভাব বাড়াতে আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়ছে। কিন্তু ওই ক্ষেত্রে তারা খুব যে সফল তা বলা যাবে না।


বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের গুলি ও গোলা ছোড়ার ঘটনা বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার যে তরিকা অনুসরণ করছে তা খুবই গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের প্রতিটি ইঞ্চি ভূমি রক্তের মূল্যে কেনা। তাই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনও ছাড় নয়। মিয়ানমারের গোলা ও গুলি যতবার বাংলাদেশের ভেতরে পড়বে ততবারই বাংলাদেশের উচিত কড়া প্রতিবাদ করা। আন্তর্জাতিক ফোরামে ওই বিষয়টি নিয়ে কথা বলা। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের চলমান সামরিক তৎপরতা সম্পর্কে প্রতিমুহূর্তের খবর সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো। যত দুর্গমই হোক না কেন সীমান্ত এলাকায় টহল দেওয়ায় সচেষ্ট থাকা।


মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া মর্টার ও গুলি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়লেও এই মুহূর্তে মিয়ানমারের বাংলাদেশ আক্রমণের কোনও সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের সাথে কোনও যুদ্ধে এখনই জড়াতে তারা আগ্রহী এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই। তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার যুদ্ধে জড়াবে না– এমনটা বলাও কঠিন।


তাই সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টার ও গোলা ছোঁড়ার বিষয়টির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সেন্টমার্টিনসহ বঙ্গোপসাগর এলাকায় তাদের তৎপরতা এবং সেন্টমার্টিনকে তাদের মানচিত্রে মিয়ানমারের অংশ বলে প্রকাশ করার ঘটনা মনে রাখা। যদিও বাংলাদেশের প্রতিবাদের মুখে তারা সেন্টমার্টিনকে তাদের মানচিত্র থেকে বাদ দিয়েছে। কিন্তু তারা গোপনে গোপনে সেন্টমার্টিনকে তাদের অধিকারে নেওয়ার প্রকল্প বাদ দিয়েছে এমনটি মনে হয় না। তাদের ওই গোপন প্রকল্পের অন্যতম টার্গেট যে বাংলাদেশ তা বলা যায়। সুতরাং বাংলাদেশের উচিত মিয়ানমারের দিকে আরো মনোযোগ দেওয়া। কারণ বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে অদূর ভবিষ্যতেও যুদ্ধের কোনও সম্ভাবনা নেই।


আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ। যদি আরাকান আর্মি রাখাইন এলাকা অধিকার করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ খুব সহজে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারবে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য আরাকান আর্মির তখন বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন হবে। একদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে লড়ে অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে রাখাইনে তাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। ফলে তারা বাংলাদেশ সরকারের দাবি মতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাধ্য হবে। অথবা বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গাদের আরাকানে পুশব্যাক করে তাহলে তাদের পক্ষে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া কঠিন হবে। তাই মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধের ফলাফল বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের উচিত ওই যুদ্ধের ওপর পূর্ণ নজর রাখা।

করনীয়:

১) বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যারা মায়ানমারের অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে তাদের উচিত আরাকান আর্মিকে সামরিক সহায়তা দেওয়া।

২) বাংলাদেশ যুদ্ধে না জড়ালেও সামরিক প্রস্তুতি গ্রহন করে রাখা।


৩) আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মায়ানমারের উচ্ছৃখল আচরনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা।


৪) কঠোর কুটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা,যেমন আজ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় মায়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেছে,এমনকি চায়ের অফার করা হয়নি।


৫)আন্তর্জাতিক আদালতে মায়ানমারের বিরুদ্ধে গনহত্যার বিষয়ে সঠিকভাবে তদারকি করা।


৬)অতি আবেগীদের খপ্পরে পড়ে রোহিঙ্গাদের আর আশ্রয় না দেওয়া কারন অতি আবেগী ধর্মীয় চেতনাবাজদের চেচামেচি ৭১'র সালে পাকিদের পক্ষে ছিল, এরা বাস্তবতাবিমুখ,দেশ এবং দেশত্ববোধ এদের কাছে নস্যি।


৭) সচেতন নাগরিকদের উচিত বাস্তবতা অনুধাবন করা সরকারকে সমর্থন অব্যাহত রাখা।


মিয়ানমার চীনের তল্পিবাহক একটি ভূখন্ড যা জনকল্যান বিমূখ,শুধুমাত্র উচ্চ পদের সামরিক কর্মকর্তাদের বিলাসী জীবনের জন্য নিবেদিত,রাষ্ট্রটি বিশ্বের দু' তিনটি দেশ ব্যতীত বিচ্ছিন্ন এবং ঘৃনিত।অন্যদিকে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের দিকে ধাবিত একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্র,বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সাফল্য অনুকরণীয়। তাই ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হবে,কারও উস্কানীতে পা দিয়ে মায়ানমার সামরিক জান্তার কাতারে শামিল হওয়া যাবেনা। কারন কুকুরে কামড় দিলেও কুকুরকে কামড়ানো যাবেনা



লেখক : মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ , ব্যাংকার ও সাবেক ছাত্রনেতা