করোনা সংক্রমন: দ্রুত শনাক্তকরণ ও কোয়ারেন্টাইনমুক্ত চিকিৎসকই বড় চ্যালেঞ্জ
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২০, ১২:৪৫ পূর্বাহ্ন | মতামত

ডা. মো. ছায়েদুল হক:
করোণা সংক্রমন এখন বৈশ্বিক মহামারী। সাড়া বিশ্ব থমকে গেছে মহামারীতে। নতুন আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুর মিছিল ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্বকে। অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশও আক্রান্ত করোণা সংক্রমণে।বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ফিরে আসা পরবর্তী কোয়ারেন্টাইন সঠিকভাবে মেনে না চলায় বিষয়টি ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। চীনে অবস্থা অনেকটাই উন্নতির দিকে হলেও উইরোপে এটি অনেক দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। ইটালি, স্পেন ও ইরানে এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে করোণা সংক্রমণ দ্রুত বিস্তালাভ করছে।আরএনএ গ্রুপের ভাইরাসটির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো এটি ক্রমাগত তার গড়ন বদলে ফেলছে অর্থাৎ মিউটেশন হচ্ছে। ফলে এটির বিপরীতে কোন প্রতিষেধক বা ভেক্সিন আবিস্কার কঠিন হয়ে যাচ্ছে।এখন অব্দি এর কোন কারযকর চিকিৎসা আমাদের হাতে নেই। বিশেষজ্ঞদের অভিমত এ থেকে সহজে বেড়িয়ে আসা কঠিন।
বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আক্রান্তদেরকে সুস্থদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যাতে ভাইরাসটি নতুন করে কাউকে আক্রান্ত করতে না পারে। সংক্রমিত রোগীর কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে বা বিচ্ছিন্ন থাকার কয়েকটি উপায় ইতিমধ্যে বিবেচনায় নিয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। যেমন সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা সোসাল ডিস্টেন্সিং; কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা সোসাল ডিস্টেন্সিং প্রয়োগ করা হয় যখন ব্যাপকভাবে কোন এলাকায় এটি ছড়িয়ে পড়েছে বা ছড়িয়ে পড়ার হুমকি সৃষ্টি হয়েছে।সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বা সোসাল ডিস্টেন্সিং যেমন গনজমায়েত; স্কুল কলেজে জমায়েত; সামাজিক ও ধর্মীয় জমায়েত; ভ্রমন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত করা।
কোয়ারেন্টাইন হলো কোন ঝূকিপূর্ণ ব্যাক্তি যে কিনা কোন সংক্রমিত রোগীর নিবিড় সংস্পর্শে বা ক্লোজ কন্টাক্টে এসেছে অর্থাৎ তার মধ্যে ভাইরাসটির বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনা আছে এবং ভবিষ্যতে সংক্রমনের উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা দিতে পারে তাকে সাময়িকভাবে (করোণা ভাইরাসের ক্ষেত্রে ১৪ দিন) অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা।কারণ হলো তার দেহে যদি ভাইরাসটি সত্যি সত্যি বিদ্যমান থাকে তার দেহে লক্ষন দেখা দিতে অনধিক ১৪ দিন সময় প্রয়োজন হলেও তাৎক্ষনিকভাবে তার দেহ থেকে অন্যদের দেহে ভাইরাসটি ছড়িয়ে যাবে।তবে যদি তার মধ্যে তাৎক্ষনিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তার দেহে ভাইরাসের উপস্থিতি নেই অথবা পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে তার দেহে কোন সংক্রমনের লক্ষন বা উপসর্গ পরিলক্ষিত না হয় সেক্ষেত্রে সাধারনের সাথে মেলামেশা বা স্বাভাবিক জীবন যাপনে অসুবিধা নেই।নিবির সম্পর্ক বা ক্লোজ কন্টাক্ট বলতে অনধিক ৬ ফুট দূরত্বে অনেকটা সময় ( ১৫মিনিট বা তার বেশী) সংক্রমিত রোগীর সাথে কাটিয়েছে যেমন চিকিৎসক যখন প্রোটেকশন ছাড়া রোগীর চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত থাকেন; ভ্রমনের সময় বা মিটিংএ পাশাপাশি সীটে থাকা; লাউঞ্জে বা কোন ওয়েটিংএ পাশাপাশি অপেক্ষা করা; একসাথে বসবাস করা; সামাজিক বা ধর্মীয় সমাগমে পাশাপাশি অবস্থানে থাকা ইত্যাদি বূঝানো হয়ে থাকে। কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালীন যদি কারো দেহে করোণা সংক্রমনের উপসর্গ দেখা দেয় তবে তাকে দ্রুত সেখান থেকে আলাদা ব্যবস্থাপনায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে।
কোয়ারেন্টাইনে কতকগুলো মৌলিক বিষয় অবশ্যই মেনে চলতে হবে। বিচ্ছিন্ন বা কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তি আলাদা ঘরে একাকী থাকবেন। ঘরের দড়জা বন্ধ করে রাখবেন।খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি নিজ ঘরেই সাড়বেন। অত্যাবশ্যকীয় (যেমন কোন চিকিৎসার প্রয়োজন) না হলে ঘর থেকে বেড় হবেন না। বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হলে আলাদা ঘর ও আলাদা বাথরুম এর ব্যবস্থা করতে হবে।ব্যবহারের জিনিষপত্র আলাদা রাখতে হবে। হাত মুখ ভাল করে সাবান পানি দিয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।বাসার অন্যদেরও সাবান দিয়ে হাত মুখ ধূয়ার অভ্যাশ করতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের দেওয়া নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে।
পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমানিত করোণা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে অথবা ক্লিনিক্যালী যদি মনে হয় করোণা আক্রান্ত এবং সেক্ষেত্রে পরীক্ষার সূযোগ না থাকলে তাকে সাধারন থেকে অথবা কোয়ারেন্টাইনে থাকা অন্যদের থেকে আলাদা করে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে রাখতে হবে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। সংক্রমিত কাউকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হলো আইসোলেশন।
বাংলাদেশে ইতিমধ্যে সীমিত লকডাউন অবস্থা চলছে। সর্বশেষ খবর হলো আক্রন্তের সংখ্যা আইইডিসিআর এর তথ্য মতে ৪৪ এবং মৃতের সংখ্যা ৫। বেশ কিছু আছেন আইসোলেশনে। কোয়ারেন্টাইনে আছেন কয়েক হাজার হাজার।অনেকের ধারণা শনাক্তকরণের পরিধি বাড়ানো হলে সংখ্যা বেশী হবে । ইতিমধ্যে ঢাকা এবং বাইরে বিভিন্ন এলাকা থেকে সংক্রমনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। অনেক হাসপাতালে করোণারোগী মৃত্যুবরণ করায় সেখানে অনেক চিকিৎসক কোয়ারেন্টাইনে যেতে বাধ্য হয়েছেন।বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাববার সময় হয়েছে।চিকিৎসকদের এভাবে কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার পিছনে দুটি বিষয় ভূমিকা রাখছে বলে মনে হয়। প্রথমত রোগী তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিজেও বিপদে পড়ছেন এবং সেবাদান কাজে নিয়োজিতদেরও বিপদে ফেলছেন।দ্বিতীয় কারণটি হয়তো যথাযথ ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার না করেই করোণার উপসর্গ আছে বা ঝূকিপূর্ণ সন্দেহে কাউকে শনাক্তকরণ নিশ্চিৎ না হওয়া অব্দি চিকিৎসা প্রদান করতে যাওয়া। উপসর্গ জোড়ালো হলে বা হঠাৎ রোগীর মৃত্যুবরণ করলে তখন বিষয়টি নিয়ে তৎপরতার পর যখন করোণা নিশ্চিৎ হয় তখন দেখা যায় অনেক চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সেবাদানকারী ইতিমধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির নিবিঢ় সংস্পর্শে থেকেছেন এবং করোণার সংক্রমনের ঝূকিপূর্ণ হিসাবে পরিগনিত হয়ে পড়েছেন।করোণাযুদ্বে প্রথম সারির যোদ্বা হিসাবে চিকিৎসা সেবা কাজে নিয়োজিত সেবা প্রদানকারী যথাযথ সুরক্ষা ব্যতিরেখে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে করোণা সংক্রমনের ঝূকিতে পড়ে গেলে এক সময় সার্বিকভাবে বিষয়টি আরো জটিল আকার ধারণ করবে।এসমস্যা থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে বিশেষ কতগুলি বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে।
প্রথমত চিকিৎসা সেবা কাজে নিয়োজিত সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক, নার্স, ও অন্যান্য স্টাফদের জন্য যথাযথ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিৎ করা প্রয়োজন। করোণা শনাক্তকরন টেষ্ট সহজলভ্য ও দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা এবং এর পরিধি আরও ব্যপক করা প্রয়োজন।দ্রুততার সাথে শনাক্তকরণের মাধ্যমে সমাজ থেকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সংখ্যক সংক্রমিত ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বিচিাছন্ন করে আইসোলেশনে নিতে হবে। সাধারন চিকিৎসাকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে করোণায় আক্রান্ত বা ঝূকিপূর্ণ (উপসর্গ ও ক্লোজ কন্টাক্ট বিবেচনায়) ব্যক্তির চিকিৎসা থেকে আলাদা করে রাখার চেষ্টা করতে হবে।এক্ষেত্রে রোগীর তথ্যযাচাই প্রক্রিয়া; করোণার প্রাথমিক উপসর্গ; করোণার শনাক্তকরণ টেষ্টের উপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
কোয়ারেন্টাইন , আইসোলেশন ইত্যাদি কাজগুলি যাদের তত্যাবধানে হবে তারা নিজেরাই যদি অরক্ষিত থাকেন এবং শুরুতেই সংক্রমিত হয়ে পড়েন তবে সার্বিকভাবে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে দাড়াবে।তাই বর্তমান লকডাউনের পাশাপাশি শনাক্তকরণ ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর উপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
[লেখক-
ডা. মো. ছায়েদুল হক
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন
এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক
আইডিয়াল আই কেয়ার সেন্টার লিঃ
৩৮/৩-৪, রিং রোড,আদাবর, ঢাকা।
Mail: sayedul.hq@gmail.com]