করোনা শিক্ষা সময় এসেছে আত্মশুদ্ধি ও পরিবর্তনের

 প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২০, ১১:৫৩ পূর্বাহ্ন   |   মতামত

করোনা শিক্ষা সময় এসেছে আত্মশুদ্ধি ও পরিবর্তনের

পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন রকম প্রকৃতির মহামারী ছিল, আছে এবং থাকবে। ১৭২০ সালে প্লেগ, ১৮২০ সালে কলেরা, ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে আবার জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় এসেছে। ২০২০ করোনা নামক ভাইরাস অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার বিশ্বঅর্থনীতিকে আজ স্থবির করেছে। এই মহুর্তে প্রায় বিশ্বের ২০৬ দেশ এই সংক্রমিত ভাইরাসে আক্রান্ত। গোটা পৃথিবীতে আজ নেমে এসেছে আজ হীম শীতল অচল স্তব্ধতা। এক দিকে বিরাজ করছে আতঙ্ক, অন্য দিকে মৃত্যুভয় তাড়া করছে। ভালবাসা, প্রেম,স্নেহ, মমতা শব্দগুলি নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। জন্মদাত্রী মা তার সন্তানকে কাছে টানতে পারছে না। ভালবাসার প্রাণপ্রিয়তমাকে স্বামী কাছে রাখতে পারছে না। সামাজিক-পারিবিক সাহায্য-সহযোগীতা বন্ধন আজ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ছে। মানুষ তার নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ করতে পারছে না। মিটাতে পারছে না দৈনন্দিন চাওয়া পাওয়াকে। আতঙ্ক আর মৃত্যু তাড়া করছে সবাইকে। রোগ, শোক, জরাজীর্নতা পৃথিবীতে শুধু আজকেই নয়, কিন্তু করোনার তান্ডবলীলা ধনী-দরিদ্র, দিনমজুর কাউকেই ছাড়ছে না। জন্ম যার আছে মৃত্যু তার হবে এটাই স্বাভাবিক। নূন্যতম চিকিৎসা সেবা কিংবা মৃত্যু পূর্বমুহুর্তে স্বাভাবিক কিছু চাওয়া পাওয়াতো থাকতে পারে। কিন্তু করোনা মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু থেকেও অত্যন্ত কষ্টদায়ক। এই মৃত্যুতে রোগীর আপনজন, প্রিয়মানুষগুলি যাদের জন্য সারাজীবন কষ্ট আর দুঃখ করেছে তারা আজ কেউ পাশে থাকছে না। বিশেষভাবে বলতে হয় সহযোগীতা দুরের কথা মানবিকতাবোধও যেন আমরা হারিয়ে ফেলছি কিছু কিছু ক্ষেত্রে। সরকার করোনা রুগি শনাক্তের পর তার চিকিৎসা সেবা করার জন্য উত্তরা আবাসিক এপার্টমেন্ট প্রকল্পে সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা করলে এলাকাবাসীর প্রতিবাদে তা প্রত্যাহার হয়েছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দুই বিঘা খালি জমির উপর অস্থায়ী হাসপাতাল বানাতে গেলে সেখানে বাঁধা এসছে। বগুড়ার শিবগঞ্জে জ্বর, সর্দি, কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তির স্ত্রী সারা রাত এলাকাবাসী, হাসপাতালে গিয়েও কোন সাহায্যে পাইনি। এমনকি তার মৃত্যুর পর স্বাভাবিক দাফন কাজটিও হয়নি। পরবর্তীতে জনগণের বন্ধু আজ সেই পুলিশ তারাই সরকারি ভাবে খাস জমিতে ঐ ব্যক্তির দাফন সম্পন্ন করে। স্বাভাবিক জ্বর, ঠান্ডা কিংবা ফুসফুস জনিত সমস্যায়ও গেলে নূনতম সেবা থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। কারন করোনা আতঙ্ক। মৃত্যু ঝুঁকি। এ যেন নিজে বাঁচলে বাপের নাম। প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক গুলো বন্ধ করে নাকে তেল দিয়ে বাড়িতে ঘুমাচ্ছে। যত চিন্তা আর দায় সরকারের। কিন্তু সরকার ২৬ শে মার্চ থেকে ৪ ঠা এপ্রিল পর্যন্ত সরকারী বেসরকারী সাধারণ ছুটি ঘোষনা করল। যার যার জায়গায় হোম কোয়ারেন্টিন করার জন্য। ঘোষনার পর মানুষ ছুটলো গ্রামের উদ্দেশ্যে যেন ঈদ পালনের ছুটি। হুমড়ি খেয়ে বাস, ট্রাক, রেল, স্টীমারে যে যেমন পারে কার আগে কে যাবে সেই প্রতিযোগিতা। কেন ছুটি ? কিসের ছুটি ? কিসের দ্বায়িত্ব ? সব হারিয়ে বাড়ি যেয়ে চায়ের স্টলে আড্ডা, চা খাওয়া আর সমালোচনার ঝড়। এটাই কি ছুটির কারণ! নাকি সচেতনতার দৃষ্টান্ত। কোন কিছুই কি কাজে লাগবে যদি আমরা আত্বসচেতন না হই। যুদ্ধ, বিগ্রহ, লোভ, লালসা, ক্ষমতার দ্বন্দ¦, সারা পৃথিবীতে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সা¤্রাজ্যবাদ থেকে সরে অর্থনৈতিক ক্ষমতা লড়াইয়ের যুদ্ধে মেতেছে অনেকে। যুদ্ধ করে বিনাশ করেছে অনেক সম্বাবনার প্রানকে। হাতির পায়ের নিচে পড়ে পিপড়া যেমন পিষে মরে, তেমনি অনেকেই ক্ষমতার লড়াইয়ে পিষে মরছে। স্বার্থের প্রাণহানিতে আমরা বিশেষ ভ‚মিকা রাখছি। প্রতিনিয়ত জৈব-রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির গবেষনা চলছে। বিভিন্ন দেশসমূহ সমরাস্ত্র ক্রয়, গবেষনা আর মজুদে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। যত্রতত্র রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার হচ্ছে। খাদ্য দ্রব্য থেকে শুরু করে জীবনরক্ষাকারী ঔষধেও বিচার বিশ্লেষণ না করে মুনাফার লোভে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহারিত হচ্ছে। আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে বিপদজনক রাষয়নিক মজুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ। অতি নিয়ন্ত্রিত ভাবে গড়ে উঠা ইটের ভাটা, মেডিক্যাল দ্রব্যাদির বর্জপদার্থ, শিল্পকলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, প্লাস্টিক পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহার। আজ বায়ু দূষন, পানি দূষন, শব্দ দূষন, কিডনী, ফুসফুস, হৃদযন্ত্র, ডায়বেটিকসসহ অসংখ্য রোগ মহামারী আকার ধারণ করলেও কিছু চিকিৎসা আছে। চিকিৎসাকালীন সময়ে আপনজন সেবা করতে পারছে। অন্তত শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও কিছু সান্ত¡না দিয়া যায়। কিন্তু এই ভাইরাস এতটাই মারাত্বক যে, ভালবাসা, ¯েœহ মমতা থেকে ব্যক্তি হচ্ছে বঞ্চিত। দূর থেকে চোখের পানি ছাড়া আর কিছুই বা করার থাকছে না। প্রাকৃতিক দূর্যোগ সাইক্লোস, বন্যা, ঝড়, ভ‚মিকম্প, দাবানল কিংবা জলোচ্ছাসের মতো একাধিক দূর্যোগ আমরা মোকাবেলা করছি। কিন্তু অদৃশ্য যমদূত বাতাসে হাঁচি, কাশি, ছোঁয়াচে ব্যধি কোন পাপের ফসল তা একমাত্র বিধাতা ছাড়া কি কেউ বলতে পারে ? যদি সত্যই জানা যেত বা কি তার প্রতিকার তবে অবশ্যই আমরা সমাধানের পথ বের করতে পারতাম। এই ভাইরাস নিয়ে গবেষনা পদ্ধতি চলছে। ঔষধও আসবে, ভ্যাকসিন হবে তবে সেটা কবে ? সবাই কি আমরা এক সাথে পাব ? এর মধ্যে অর্ধলক্ষ মানুষের প্রাণ হারিয়েছে। ১ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত। দিনে দিনে জ্যামেতিক হারে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। মৃত্যু মিছিলে মানুষ যোগ দিয়েছে। বলতেই হচ্ছে “হে আল্লাহ্ আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই শ্বেত, উম্মাদনা, কুষ্ঠ এবং সব ধরণের দুরারোগ্য ব্যধি থেকে”। (আবু দাউদ:১৫৫৪)। মার্চের ৮ তারিখ প্রথম ইতালি ফেরত এক প্রবাসীর দেহে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হলে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। শতবছরের অনুষ্ঠান মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান সীমিত, স্বাধীনতা দিবসসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার সচেতনতা ও বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। লকডাউন অবস্থায় খাবার পৌছানোর ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ঘোষনা দিয়েছে। শত সমস্যা আছে আমাদের তারপরও সীমিত সম্পদ দিয়ে সকলের সহযোগীতা চেয়ে এই মহামারীকে মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চালাচ্ছে। এর পর কিছু লোক দূর্নীতি দূর্বাতয়নসহ বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। কোন জাতীয় সমস্যা একক ভাবে সমাধান করা যায় না। সকলে মিলে চেষ্টা করে আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাইলে হইতোবা আমরা এই ভাইরাস যুদ্ধে জয় হব ইনশাল্লাহ্। আমাদের মানবিকতাবোধ, ভ্রাতৃত্বাবোধ, সহমর্মিতাবোধ বাড়াতে হবে।  মানুষ্যত্ববোধ আছে বলেই আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। ডাক্তারি একটি মহান পেশা। বলা হয় উপরে আল্লাহ্ আর নিচে ডাক্তার। সেই ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থকর্মী, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্তাব্যক্তি, ধনিক শ্রেণী, সম্পদশালী আজ বসে না থেকে “মানুষ মানুষের জন্য” এই নীতিতে আমরা পাশে দাঁড়াই। যে মানুষটি মারা যাবে বা যাচ্ছে ধরুন সেই আপনার প্রিয় আপনজন। সেই অভুক্ত আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মি কিংবা ভোট দিয়ে আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আজ এই দুর্য্যােগ মুহূর্তে মানবিক ও মানবতার চরম দৃষ্টান্ত হতে পারে হাজার নতুন প্রাণের স্পন্দন। করোনা ভাইরাস মহামারীর এই সংকট আমাদের অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে শিক্ষা দিচ্ছে। এই সমস্যা শধু সমস্যায় নয় এটা হবে আগামী দিনের জন্য সমাজ, দেশ ও জাতি পরিবর্তন সহ নিজে আত্মশুর্দ্ধি আর নতুন পরিকল্পনার এক দৃষ্টান্ত। যেখানে সমৃদ্ধি উন্নয়ন ও সুশাসন প্রাধন্য পাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করা হয়েছে। এই প্যাকেজের আওতায় ক্ষতিগ্রস্থ ক্ষুদ্র ও মাঝাড়ি শিল্প, ভারি শিল্প, কৃষকের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা মুদ্রাস্ফৃীতি নিয়ন্ত্রনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও ব্যাংকের তারল্য সংকট মোকাবেলায় নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত। শধু প্যাকেজ ঘোষনা করলেই হবে না, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো যাদের জন্য ব্যবস্থা করা হলো তারা যেন ঠিকমত সেটা যেন পায় তার তদারকি করা। আশা করি অর্থনৈতিক সংকট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেত্রিত্তের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে পারবো। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায়।

লেখকঃ সৈয়দ নাজমুল হুদা, শিক্ষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।

মতামত এর আরও খবর: