করোনা প্রভাবিত চ্যালেঞ্জিং বাজেট : প্রত্যাশিত ও করণীয় কিছু কল্পচিত্র

 প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২০, ০৫:০৪ অপরাহ্ন   |   মতামত

করোনা প্রভাবিত চ্যালেঞ্জিং বাজেট : প্রত্যাশিত ও করণীয় কিছু কল্পচিত্র

সৈয়দ নাজমুল হুদা: 

১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল জেমস উইলসন কলকাতা ভারতে (১৮৬০-৬১) অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। যা ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক বাজেট প্রনয়ন, উপস্থাপন ও অনুমোদনের প্রথা হিসাবে প্রবর্তিত। ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খেকে শাসনভার গ্রহণের পর এ ভাবে বাজেট পেশ করেন। এর আগে সম্রাট আকবর প্রবর্তিত ফসলি সনের আদলে (এপ্রিল-মার্চ) কে অর্থবছর ধরে বাজেট করা হতো। এরও আগে রাজা-বাদশা, জমিদারী প্রথা প্রচলনে তাঁরা তাদেও মতো করে বাজেট করে থাকতো। বাজেট মূলত একটি দেশের পরিকল্পনার মূল দলিল, আয়-ব্যয়ের খতিয়ান, আর্থসামাজিক উন্নয়নের দিক নির্দেশনা, ব্যক্তি ও সামস্টিক অর্থনীতির সকল সূচকের জবাবদিহিতা ও দক্ষতার পথনির্দেশিকা। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি, উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফিরিস্তি, রাজস্বের নীতিমালা, বার্ষিক বরাদ্দের পরিমাণ ইত্যাদি। বাজেট একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরকে ঘিরে আবর্তিত হলেও এখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষৎকে মূল্যয়িত করে একটি সুনির্দিষ্ট রুপরেখা তৈরি করা হয়। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেট পেশ করেন তাজউদ্দীন আহম্মেদ, ৩০ জুন ১৯৭২। এ পর্যন্ত অন্তর্বতীকালীন বাজেট সহ সর্বমোট ৪৯ টি বাজেট পেশ করা হয়েছে। যার মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটের আকার ও পরিধি ছিল বিরাট। এটা বাস্তবায়ন ও চ্যালেঞ্জ যেমন ছিল, তেমনি তদারকির বিষয়টি ছিল বিবেচ্য। অর্থবছর শেষ হতে না হতেই করোনা ভাইরাস নামক মহামারী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি চ্যালেঞ্জিং প্রভাব সৃষ্টি করেছে। ৫ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার ব্যয়ের বিপরীতে ৩ লক্ষ ৮১ হাজার কোটি টাকার আয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ঘাটতি ছিল ১ লক্ষ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। বাজেটের আকার যেমনই হোক না কেন, বাজেট হতে হবে কর্মসংস্থানমূখী, বিনিয়োগবান্ধব ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নির্ভর। এক্ষেত্রে বাস্তবায়নে সরকার বরাদ্ধ বন্টন আর রাজস্ব আহরণে বিশেষ মনোযোগী হতে হয়। রাজস্ব আয় বৃদ্ধি আর ঘাটতি কমানো এবারের বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ হবে। সেক্ষেত্রে কর হার না বাড়িয়ে কর জাল বাড়াতে হবে। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে কাউকে সুবিধা দিতে গিয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠি যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ২ লক্ষ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা ধরা ছিল উন্নয়ন ব্যয় বাবদ। যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর বরাদ্দ ২ লক্ষ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। দেশের ৬২ টি মন্ত্রানালয় ও বিভাগে খাত-উপখাত ওয়ারি তথ্যাদি সংগ্রহ করে দেখতে হবে উন্নয়নের বরাদ্দকৃত অথচ এখনও ব্যয় হয়নি এমন অর্থের প্রকৃত পরিমাণ কত? আগামী দুইমাস ব্যয় না করলেই নয় এমন খাত-উপখাত গুলি চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ঠ যুক্তি গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে ভাউচার তৈরির সংস্কৃতিও হয়তোবা পাল্টে যাবে। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপি আর্থিক সংকট দেখা দিলে স্বয়ং আমেরিকা তাদের ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর জন্য রাজস্ব খাত থেকে ভর্তুকি দিয়েছিল। যা অর্থনীতিবীদরা “বেলিং আউট” হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকে। অনেকে আবার বলে লাভ হলে ব্যাংকের আর লোকসান হলে সরকারের। করোনার দোহাই দিয়ে এমন ঘটনা যেন না ঘটে সেদিকেও নজর রাখতে হবে। পুঁজিবাজারের সমস্যায় কমিশন কি করতে পেরেছে বা পারে নাই তা আলোচনা করে কিভাবে আগামি বাজেটে এই খাতকে শক্তিশালী, বিনিয়োগবান্ধব ও আস্থাশীল করা যায় সে বিষয়গুলো এবারের বাজেটে আসতে হবে। করোনা অজুহাতে খেলাপী ঋণগ্রাহকরা যেন ছাড় না পায় সেদিক টাকেও নজর দিতে হবে। পুঁজিবাজারের ২০১০ এর ক্ষতিগ্রস্থ বিনিয়োগকারীদের জন্য পোর্টফলিওতে সমাধান করে দিয়ে তাদেরকে নতুনভাবে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে হবে। প্রনোদনার অর্থ অনেকে ঠিকমত পায় না বা বুঝে না। ঘাটতি মেটানোর ক্ষেত্রে বৈদেশিক নির্ভরতা করা যাবে না। তবে এবারের করোনা বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আইএমএফ. আইডিবি সহ সকল উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগীতা নেওয়া যেতে পারে। নারী উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্টী, অটিজম শিশুদের জন্য, খেটে খাওয়া মানুষ, জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, প্রিন্টিং ও ইলেকট্রিক মিডিয়া, গার্মেন্টস শিল্পসহ সকল খাতের উপর যুক্তিযুক্ত প্রনোদনা বিবেচনা করা যেতে পারে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যদির উপর কর হার কমিয়ে বিলাশবহুল দ্রব্যদির উপর কর হার বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা যোগ্য। সংকট মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়েঁ চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি হতে বের হতে হবে। কৃষি প্রধান এ দেশের খাদ্য শস্যের উৎপাদন অব্যাহত রেখে ইহার সুষ্ঠ বন্টন ও বিপননের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। সেক্ষেত্রে ভর্তুকি বাড়ানো সহ বিপননের বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। সরাসরি কৃষককের থেকে পন্যদ্রব্য ক্রয়ে ও বিক্রয়ে কার্ড প্রথার মাধ্যমে কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। কৃষি ও কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ শিক্ষার হার কম, কিন্তু বিশেষায়িত শিক্ষার্থীর হার অনেক বেশী। প্রযুক্তি বিদ্যার সাথে মানবিক ও বানিজ্য শিক্ষার গুরুত্ব অগ্রাধিকার দিতে হবে। গত অর্থবছরে শিক্ষাক্ষাতে ৮৭ হাজার ৬২০ কোটি টাকার যে বরাদ্দ ছিল তা মোট জিডিবির তিন দশমিক শূন্য চার শতাংশ। এটিকে এ বাজেটে ননূতম চার শতাংশে উন্নীত করার ব্যবস্থা করতে হবে। গবেষনা ও চিকিৎসায় বিশেষ বরাদ্দ তহবিল গঠন করে তা বাস্তবায়িত করতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে ফেস করতে হবে। শিক্ষীত বেকার তৈরি না করে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করতে হবে। আধুনিক, কারিগরি ও বাস্তবশিক্ষায় নজর বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যখাতের বাজেট ১ হাজার ৪২৫ কোটি টাকাকে বাড়ানোর চিন্তা এখনি করতে হবে। স্বাস্থ্য সেবাকে প্রাধন্য দিয়ে স্বাস্থ্যবীমা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতের বিষয়টি এ বাজেটে বাড়ানো নয় বাস্তবায়িত করতে হবে। করোনার প্রভাবে সৃষ্টিকৃত আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের উপর প্রভাব, রপ্তানীমুখী শিল্প, ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্পের সম্প্যসারন, পরিবহন, সেচখাত ও ক্রয়ক্ষমতার দক্ষতা বৃদ্ধি, মেগাপ্রকল্পগুলো চালু রাখা,পর্যটর শিল্প, রেমিটেন্স প্রবাহ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নতুন নতুন উদ্যেক্তাদের বিশেষ নজরদারি করতে হবে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষনা মতে, প্রতিবছর ২২ লক্ষ মানুষ শ্রম বাজারে প্রবেশ করে কিন্তু ৭ লক্ষ কাজ পায় ১৫ লক্ষ বেকার থাকে। বাংলাদেশের বাহিরে অবস্থানরত ১ কোটি লোকের পাঠানো রেমিটেন্স জিডিপির প্রায় ১২ শতাংশ। মানণীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন “২০২৩-২৪ সালের প্রবৃদ্ধির হার হবে ১০ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৫০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হওয়ার প্রত্যাশা। অতি দারিদ্রের হার ৪ শতাংশ নামিয়ে আনার লক্ষ নির্ধারণ করা হয়েছে”। সুস্থ দেহ, সুস্থ মন আর নবকর্মউদ্যমে করোনা মোকাবেলা করে আমাদের মানব সম্পদ উৎপাদনে ভুমিকা রাখবে। জিডিপিতে বিশেষ অবদান রাখবে। করোনা সমস্যা বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক। এটাকে ধের্য্য আর সংযমের মাধ্যমে মোকাবেলা করে একটি যুগোপোযোগী আর্থিক বছরের বাজেট নিয়ে আসবে জনমনে স্বস্তি¡। সকল সমস্যা সমাধান করে আমরা আমাদের কাঙ্খিত সাফল্য পৌছাব। এটাই হবে এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। জনবান্ধব, মানবকল্যান, শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ৫০ তম বাজেটের প্রত্যাশায়। সুশাসন ও কল্যানময় হবে আমাদের অর্থনীতি। রুপকল্প-২০৪১ হবে বাস্তবায়িত। দেশ হবে উন্নত, সুখী সমৃদ্ধ স্বপ্নের সোনার বাংলা।



লেখকঃ সৈয়দ নাজমুল হুদা, শিক্ষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।