উইঘুর নয় চীনের সবচেয়ে বড় মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম ‘হুই’

 প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৫:২৬ অপরাহ্ন   |   মতামত

উইঘুর নয় চীনের সবচেয়ে বড় মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম ‘হুই’


মোঃ মোর্তুজা মিশু:


চীনে ইসলামের ইতিহাস শুরু হয় যখন সাহাবা সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (৫৯৪-৬৭৪), জাফর ইবনে আবি তালিব,এবং জাহস সহ চারজন সাহাবী ৬১৬/১৭ সাল থেকে চীনে এসে ধর্মপ্রচার শুরু করে। তারা ৬১৫/১৬ সালে আবিসিনিয়া থেকে জাহাজে যাত্রা করে চট্টগ্রাম-কামরূপ-মনিপুর রাস্তা ধরে চীনে পৌঁছান। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস পুনরায় তৃতীয়বারের মত ৬৫০-৫১ সালে খলিফা উমরের কথায় চীনে দূতের দলের নেতা হয়ে যান। সেই দূতের দলকে চীনের সম্রাট উষ্ণতার সাথে গ্রহণ করেন। ট্যাং সম্রাট গাওজং তাদেরকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান এবং ক্যান্টনে স্মারক মসজিদ নির্মাণ করতে আদেশ করেন। এটি ছিল দেশটির প্রথম মসজিদ যা নবী মুহাম্মাদ (সঃ)স্মৃতি রক্ষার্থে তৈরি হয়।

উইঘুরদের চীনে বসবাসরত মুসলিম। চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে এদের বসবাস এবং সংখ্যায় প্রায় এক কোটি দশ লাখের মত।পরিচয়ের বেলায় তারা নিজেদেরকে সাংস্কৃতিক ও জাতিগতভাবে মধ্য এশীয়র লোকজনের কাছাকাছি বলে মনে করেন। তাদের ভাষা অনেকটা তুর্কী ভাষার মতো যা লিখা হয় অারবী হরফে। তারা মূলতো বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান এসব দেশ থেকে চীনে এসেছে। তাদের চেহারা বা চলাফেরায় তারা চীনা জাতী থেকে অালাদা এবং দেখতে অনেকটা অারবীয়দের মতো। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অাছে। ভাষা, সংস্কৃতি, চেহারা বৈচিত্র্যতার কারনে চীনা সরকার মনে করেন যে উইঘুর জাতী হয়তো স্বাধীনতাকামী হয়ে উঠতে পারে। তাই চীনা সরকার এদের উপর সবসময় অত্যাচারী শাসকেরা ভূমিকা রাখে। অার অত্যচারীত হওয়ার কারনেই মূলত বিশ্বব্যাপী উইঘুর জাতীকে চীনে সবচেয়ে বড় মুসলীম জাতী হিবেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে। চীন সরকার উইঘুর জাতীর বসবাসরত অঞ্চল শিনজিয়াং কে মূলত বন্দীশিবিরে পরিনত করে রাখা হয়েছে। জাতিসংঘের ধারনামতে, প্রায় ১০ লাখ উইঘুর কে বন্ধী করে রাখা হয়েছে। অার এদের মধ্যে বন্ধী নারীদের বন্ধা করার জন্য নিয়ম করে তাদের ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে যাতে করে উইঘর জাতী ক্রমশই কমতে থাকে। সেখানে বন্ধীদের নিয়মিত মান্দারিন ভাষা শিখানো হচ্ছে এবং তাদের কে শিজিংপিং এর অনুসারী করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তাদের কে কোন সামাজিক মাধ্যম বা মেসেঞ্জার ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। এমনকি সেখানে কোন মিডিয়া প্রবেশ নিষিদ্ধ যার ফলশ্রুতিতে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যাচ্ছে না।

হুই জাতী জাতীতে চৈনিক। তারা অন্য কোন দেশ থেকে চীনে অাসেন নি। উইঘুর জাতী শিংজিয়াং এ বসবাস করলেও হুই জাতী সমগ্র চীনেই বসবাস করে। দাড়ী টুপি ব্যতীত হুই জাতী কে চীনাজাতী থেকে অালাদা করা দুষ্কর। হুইদেরও ‘নিজস্ব’ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আছে, যার নাম ‘নিংশিয়া’। হুই- মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। কিন্তু চীনের সঙ্গে তাদের কোন বিরোধ নেই। শুধু হুই নয়। চীনে ইউঘুর ব্যাতিত আর কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গেই চীনের বিরোধীতা নেই। শুকর আর মদ বাদে চীনাদের সাথে খাদ্যাভ্যাসেও হুইদের কোনো তফাত নেই। হুইদের মসজিদও দেখতে প্যাগোডার মতো। এছাড়া হুইরা মূলত ইসলামের সুফিবাদী আদর্শের অনুসারী। যার সঙ্গে মিল রয়েছে কনফুসিয়াসের দর্শনের। ফলে হুই মুসলিমদের আপন করে নিয়েছে চীন।চীনের সব উন্নত শহরে গেলেই হুইদের চোখে পড়বে। শহরের অধিকাংশ দোকানপাটই হুইদের দখলে। চীনের দাপ্তরিক ভাষা মান্দারিন, হুইদের মাতৃভাষাও তা-ই। ফলে সরকারি চাকরিতেও তাদের অংশগ্রহণ বেশি।

চীনের মুসলিম বলতে আমরা অনেকেই শুধু উইঘুরদের বুঝি। আর উইঘুরদের সঙ্গে মূল চীনের বৈরীতা আমাদের কাছে চীন মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবেই পরিচিত। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উইঘুর নয় চীনের সবচেয়ে বড় মুসলিম সম্প্রদায়ের নাম ‘হুই’ এবং তারা অত্যন্ত সাবলিলভাবে চীনে বসবাস করেন। তাদের সামাজিক অবস্থানও বেশ উন্নত। মূলত ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, শারিরীক ঘঠনের বৈচিত্রতার কারনেই উইঘুরদের নিয়ে চীন সংকিত৷। তাচাড়া শিংজিয়াংয়ে প্রায়ই হানজাতীর সাথে উইঘুরদের হানাহানী হত্যাযজ্ঞ লেগেই থাকে। এমনিতেই হংকং, তাইওয়ানে এর কারনে চীনকে একদেশ দুই নীতি অনুসরন করতে হচ্ছে। তাই কৌশলগত কারনে চীন তাদের মানচিত্রে অার নতুন কোন স্বাধীনচেতা জাতীর উথ্যান দেখতে চায় না। উইঘুরদের মধ্য স্বাধীনচতা মনোভাব থাকার কারনে তার নির্যাতিত, অন্য দিকে হুইরা চীনা সংস্কৃতিও ভাষায় গা ভাসিয়ে দেওয়ার কারনে বীরদর্পে সমগ্র চীনেই বসবাস করছে। উইঘুরদের সংখ্যা ১,১০ কোটির মতো যেখানে হুই জাতী প্রায় ১.৫ কোটি। কিন্তু অত্যাচারীত হওয়ায় তাদের কথা সবাই জানলেও মূলত হুই-ই চীনের সবচেয়ে বড় মুসলীম জাতি।

(লেখক: মোঃ মোর্তুজা মিশু, ব্যাংকার)

মতামত এর আরও খবর: