আগামী দুই মাস ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়বে
প্রকাশ: ১৯ অগাস্ট ২০২৫, ১১:৪১ পূর্বাহ্ন | জাতীয়

সাধারণত বর্ষা মৌসুম এবং তার পরবর্তী মাসগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। তাই ধারণা করা হচ্ছে—আরও দুই মাস ডেঙ্গু থাকতে পারে। বর্তমানে ডেঙ্গুর যে প্রকোপ আছে তা আরও বাড়তে পারে এবং সেটা সামনের দুই মাস বাড়বে। যেহেতু ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে, তাই শীতেও ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকতে পারে। গত দুই-তিন বছর শীতেও ডেঙ্গু ছিল। সাধারণত জ্বর কমে যাওয়ার ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ডেঙ্গুর জটিলতা দেখা দিতে পারে, তাই এই সময়টায় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বর্ষাকালে মশা বংশবৃদ্ধি করে, যা ডেঙ্গু বিস্তারের প্রধান কারণ। জ্বর হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। জ্বর হলে অন্য রোগের সাথে ডেঙ্গুর আলাদা পরীক্ষা করা জরুরি। ডেঙ্গু মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায় এবং স্বচ্ছ পানিতে বংশবিস্তার করে, ডেঙ্গু রোগের প্রধান বাহক এডিস মশা। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—তীব্রজ্বর, মাথাব্যথা, শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুসকুড়ি, গ্রন্থি ফুলে ওঠা, বমি বমি ভাব এবং শরীরে ব্যথা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক পদক্ষেপ না নিলে সামনে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। তাই এখনই সতর্ক হওয়া এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ডেঙ্গু ঠেকানো যাবে না: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ইত্তেফাককে বলেন, ডেঙ্গু আগামী কয়েক মাস বাড়তেই থাকবে—সেটা শীতের আগ পর্যন্ত। যদিও গত দুই তিন বছর দেখা গেছে শীতেও ডেঙ্গু থাকে। সাধারণত শীতে ডেঙ্গু কমে। কিন্তু ডেঙ্গুর যেহেতু ধরন বদলেছে, সে কারণে জোড় দিয়ে বলা যাচ্ছে না যে, কমতে পারে। তবে শীতে ডেঙ্গুর প্রকোপটা কমার সম্ভাবনা আছে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ডেঙ্গু যেহেতু মশাবাহিত রোগ, সে কারণে মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ডেঙ্গু ঠেকাতে পারা যাবে না। আমরা ডাক্তাররা হয়তো চিকিৎসা দিলাম, কিন্তু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি। এজন্যে মশা ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যার যার ঘর-দোড় পরিষ্কার রাখতে হবে, যেন তিন দিনের বেশি জমানো পানি না থাকে। ঘরের বাইরে প্রশাসনের দায়িত্ব—কোথাও যেন পানি জমে না থাকে—এটাই প্রতিরোধ। আরেকটা ব্যবস্থা হচ্ছে নিজেকে মশার কামড় থেকে রক্ষা করতে হবে। বাচ্চারা ফুলপ্যান্ট পড়বে, অযথা বাইরে যেন ঘোরাফেরা না করে। দিনে-রাতে যখনি ঘুমান, মশারি লাগিয়ে ঘুমাতে হবে। সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে। সেজন্য একদিক দিয়ে মশা নির্মূল করতে হবে, অন্যদিকে নিজের প্রটেকশনের জন্য ব্যক্তিগত সতর্কতা সবচেয়ে জরুরি। এজন্যে প্রশাসন, জনগণ সবার সমন্বতিতে পদক্ষেপ দরকার। না হলে ডেঙ্গু কমানো যাবে না।
অন্তত দুই মাস ডেঙ্গুর প্রচণ্ড প্রকোপ থাকবে: সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, বর্তমান অবস্থার চেয়ে আরও খারাপ হবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। তিনি বলেন, বৃষ্টির সময় মশা খুব একটা বাড়ছে না। কিন্তু বৃষ্টি কমে গেলেই রোগ বাড়বে, তখন এক এক করে লার্ভা ফুটে মশা হওয়া শুরু করবে। কাজেই বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরে অন্তত দুই মাস ডেঙ্গুর প্রচণ্ড প্রকোপ থাকবে। বৃষ্টি হচ্ছে, ফলে এডিস মশার প্রজননে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এখন ডেঙ্গুতে আক্রান্তের যে হার আছে তা বৃষ্টি কমে যাওয়ার পরে বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, এটা জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. হালিমুর রশীদ বলেন, ডেঙ্গু চিকিৎসায় নতুন গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী সারা দেশে চিকিৎসা হচ্ছে। মৃত্যুর হার গতবারের চেয়ে এবার অনেক কম। চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে তিনি বলেন, সারা দেশেই চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। রোগী মনে করলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১০৫ জনের। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে জুলাই মাসে, যা মোট ৪১ জন। আগস্টের প্রথম ১৮ দিনে ২২ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ ছাড়া জুন মাসে ১৯ জন মারা গেছেন, জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, এপ্রিলে ৭ জন, মে মাসে ৩ জন মারা যান। মার্চ মাসে কোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়নি, মে মাসে ৩ জন মারা গেছেন।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী পরিসংখ্যান: চলতি বছর ১৮ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে ২৬ হাজার ৭৫৮ জন। এরমধ্যে আগস্ট মাসের ১৮ দিনে ৫ হাজার ৭৭৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন এবং জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আগস্টের ১৮ দিনে হাসপাতালে গেছেন ৫ হাজার ৩৯৮ জন রোগী। এ ছাড়া জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫১ জন, জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন এবং মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি: সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩৮০ জন। এই সময়ের মধ্যে কারো মৃত্যু হয়নি। গতকাল ১৮ আগস্ট সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৬ হাজার ৭৫৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৬৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭০ জন, ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় ৬৬ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩১ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭৪ জন, খুলনায় ২৫ জন, ময়মনসিংহে ৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩৪ জন, রংপুরে ৪ জন এবং সিলেটে ২ জন ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। আর আগস্টে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৭৭৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। চলতি বছরের এ যাবত ২৫ হাজার ৩৭৬ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে।